কম্পিউটারজগতে বইছে নতুন হাওয়া। অ্যাপল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল ইন্টেল প্রসেসরের বদলে ম্যাকে নিজস্ব সিপিইউ ও জিপিইউ ব্যবহার করার। সে কথাই বাস্তব হলো অ্যাপলের ১০ নভেম্বরের ইভেন্টে। এর আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, অ্যাপলের প্রযুক্তি যেদিকে মোড় নেয়, পুরো টেকবিশ্ব সেদিকেই চলতে থাকে। সেই হিসেবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে ভবিষ্যতে অন্যান্য নির্মাতাও এআরএম প্রসেসরভিত্তিক ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার তৈরি করবে। বিস্তারিত এস এম তাহমিদের কাছে
অবশেষে চলে এলো অ্যাপলের নিজস্ব প্রসেসর চালিত ম্যাক। দুটি নতুন ল্যাপটপ ও একটি ডেস্কটপ মডেল বাজারে এনেছে তারা—তিনটির মধ্যেই থাকছে অ্যাপলের প্রথম ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ প্রসেসর—‘এম১’। তাদের দাবি, প্রসেসরটি বর্তমান ইন্টেল ল্যাপটপ প্রসেসরের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি শক্তিশালী। শুধু ম্যাক ব্যবহারকারীদের জন্যই এই পরিবর্তন বড় খবর নয়। কেননা অ্যাপলের হাত ধরে পুরো টেকবিশ্বই ইন্টেল ও এএমডির এক্স৮৬-৬৪ আর্কিটেকচার ছেড়ে এআরএম প্রসেসর ব্যবহার শুরু করার সম্ভাবনা আছে।
যে প্রসেসরে চলবে নতুন সব ম্যাক
অ্যাপল এটির নাম দিয়েছে-‘এম১’। আইপ্যাড বা আইফোনের প্রসেসরের সঙ্গে এর আর্কিটেকচারের পার্থক্য খুব বেশি নেই। অ্যাপল এটি তৈরিতে ব্যবহার করেছে ৫ ন্যানোমিটার প্রযুক্তি, ফলে অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রসেসরটিতে থাকছে ১৬ বিলিয়ন ট্রানজিস্টর। অন্যান্য এআরএমভিত্তিক প্রসেসরের মতো ‘এম১’ও আসলে শুধু প্রসেসর নয়, বরং ‘সিস্টেম অন আ চিপ’ বা ‘এসওসি’, যার মধ্যে থাকছে সিপিইউ, জিপিইউ, মেশিন লার্নিং এবং এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য নিউরাল ইঞ্জিন ও ক্যাশ মেমরি। প্রতিটি অংশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য থাকছে একীভূত মেমরি কন্ট্রোলার বা ফ্যাব্রিক। এই ফ্যাব্রিকের মাধ্যমেই এসওসির সব অংশ র্যামের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যেহেতু এসওসির মধ্যেই জিপিইউয়ের বসবাস, তাই মূল সিস্টেম ডির্যামই হবে ভিডিও মেমরি। পুরো এসওসিটি চালাতে প্রয়োজন ১০ থেকে ১৫ ওয়াট পাওয়ার।
সর্বমোট আটটি সিপিইউ কোর থাকছে এতে, যার মধ্যে চারটি থাকবে শক্তিশালী কোর এবং বাকিগুলো হবে কিছুটা কম শক্তির। সিপিইউয়ের ডিজাইন এআরএম কর্টেক্স এ৭৬ সিরিজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি অ্যাপলের নিজস্ব আর্কিটেচারে তৈরি। অ্যাপলের দাবি, এম১-এর মধ্যে থাকা সিপিইউ বাকি সব ১০ ওয়াট সিপিইউয়ের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ শক্তিশালী। গিকবেঞ্চের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রসেসরটি সিঙ্গল কোরে পেয়েছে ১৬৫৪ পয়েন্ট আর মাল্টিকোরে পেয়েছে ৭৪৩৩ পয়েন্ট, অর্থাৎ অ্যাপলের দাবি এখন পর্যন্ত যৌক্তিক। তবে এআরএম আর্কিটেকচারের সঙ্গে সরাসরি ইন্টেল বা এএমডির এক্স৮৬-৬৪ প্রসেসরের তুলনা করা উচিত নয়।
গ্রাফিকসের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ ঘোলাটে। অ্যাপলের দাবি বর্তমানের সব ১০ ওয়াট ল্যাপটপ প্রসেসরের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষমতার জিপিইউ এতে আছে, কিন্তু ১০ ওয়াট ইন্টেল বা এএমডি প্রসেসরের সঙ্গে থাকা জিপিইউ মোটেও শক্তিশালীর তালিকায় পড়ে না। এখনো কোনো বেঞ্চমার্ক বা গেমিং পারফরম্যান্স রিভিউ পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, এতে থাকছে আটটি গ্রাফিকস পাইপলাইন এবং ২৫ হাজারটি থ্রেড, সর্বোচ্চ ২.৬ টেরাফ্লপস কম্পিউটিং পাওয়ার, যা প্লেস্টেশন ৪-এর চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
ইমেজ প্রসেসিং ও মেশিন লার্নিংয়ের জন্য বিশেষ কোর কোনো ইন্টেল বা এএমডি প্রসেসরের মধ্যে এখনো দেখা যায়নি, এ কাজগুলো মূল সিপিইউকেই করতে হয়। এদিকে এম১ চালিত ম্যাকগুলো সিপিইউ ব্যবহার না করেই ১১ ট্রিলিয়ন মেশিন লার্নিং অপারেশন করতে পারবে প্রতি সেকেন্ডে। অ্যাপলের দাবি, বাকি সব আল্ট্রাবুকের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি পারফরম্যান্স দেবে এম১ সমৃদ্ধ ম্যাক।
তবে এম১ এসওসির সবচেয়ে বড় শক্তি আসলে তার ক্ষমতা নয়, বরং অত্যন্ত কম বিদ্যুৎ ব্যবহার। সর্বোচ্চ ১০ ওয়াট এবং সাধারণ কাজের সময় মাত্র ৫ ওয়াট ব্যবহার করে চলতে পারা এ প্রসেসর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফ্যান ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম। এর ফলাফল আরো হালকা-পাতলা ল্যাপটপ ও দীর্ঘ ব্যাটারি লাইফ।
ম্যাকবুক এয়ার ও প্রো
অ্যাপল সিলিকন এম১ সমৃদ্ধ প্রথম ল্যাপটপ হতে যাচ্ছে নতুন ম্যাকবুক এয়ার ও প্রো, লেট ২০২০ মডেল। দুটি ল্যাপটপেই একই প্রসেসর ব্যবহৃত হবে, তবে এয়ারের ক্ষেত্রে স্পিড কিছুটা কম পাওয়া যাবে। কেননা এয়ারে কুলিং ফ্যান থাকছে না। ল্যাপটপের ডিসপ্লে থাকছে ১৩.৩ ইঞ্চি, রেজল্যুশন ২৫৬০ এক্স ১৬০০, ব্রাইটনেস ৪০০ নিট এবং পি৩ কালার গ্যামুট সাপোর্ট, যেটাকে সব মিলিয়ে ‘রেটিনা ডিসপ্লে’ বলে থাকে অ্যাপল। অ্যাপল এম১ প্রসেসর থাকছে এতে, র্যাম ৮ অথবা ১৬ গিগাবাইট বেছে নেওয়া যাবে। স্টোরেজ শুরু ২৫৬ গিগাবাইট থেকে ২ টেরাবাইট পর্যন্ত নেওয়া যাবে! নিরাপত্তার জন্য থাকছে টাচ আইডি ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর। শুধু দুটি ইউএসবি সি পোর্ট থাকছে এতে, যা থান্ডারবোল্ট ও ইউএসবি ৪ সমর্থন করে। তবে বাদ পড়েনি হেডফোন জ্যাক। অ্যাপলের দাবি এতে ৪কে ভিডিও অনায়েসে সম্পাদনা করা যাবে। দ্রুত নেটওয়ার্কিংও বাদ পড়বে না। কেননা এতে আছে ওয়াই-ফাই ৬ ও ব্লুটুথ ৫। ব্যাটারি লাইফ বলা হচ্ছে ১৭ ঘণ্টা পর্যন্ত অনায়েসে পাওয়া যাবে। মূল্য শুরু হচ্ছে ৯৯৯ ডলার থেকে—পাওয়া যাবে চারটি রঙে।
‘ম্যাকবুক প্রো’ বলা যায় এয়ারের বড় ভাই। প্রসেসর, র্যাম, ডিসপ্লে প্রায় সবই এক। পার্থক্য, প্রোতে থাকছে কুলিং ফ্যান, ফলে এম১ চিপটি আরো বেশি পারফরম্যান্স দেখাতে পারবে। ডিসপ্লের ব্রাইটনেসও সামান্য বেশি, ৪০০-এর স্থানে ৫০০ নিট। দুঃখজনক বিষয়, পোর্টে উন্নতি দেখা যায়নি প্রো মডেলে—দুটি পোর্টেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। বাড়তি পাওয়া টাচবার ও বড়সড় টাচপ্যাড। ব্যাটারি লাইফ ১৭ থেকে বেড়ে ২০ ঘণ্টায় উন্নীত হয়েছে। মূল্য শুরু এক হাজার ২৯৯ ডলার থেকে।
দুটি ল্যাপটপই প্রায় এক কনফিগারেশন দিয়ে তৈরির মাধ্যমে অ্যাপল জানান দিয়েছে, এয়ার আর প্রোর মধ্যে তফাত এখন থেকে আইফোন আর আইফোন প্রোর মতো সামান্য আকৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে—আগের মতো দুটি পুরো আলাদা মেশিন থাকছে না।
ম্যাক মিনি
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, অ্যাপলের নতুন ম্যাক মিনিতেও এম১ চিপের ব্যবহার। এতে এম১ চিপের ব্যবহার এটা প্রমাণ করে যে অ্যাপল ডেস্কটপেও এআরএম প্রসেসর আনবে। বাড়তি হিসেবে পাওয়া, ডেভেলপাররা ম্যাক মিনি ব্যবহার করে নতুন ম্যাকওএস অ্যাপ তৈরি করতে পারবেন সহজেই—ইন্টেলে কাজ করে এআরএম অ্যাপ পরীক্ষা করার ঝামেলা পোহাতে হবে না। ম্যাকবুক প্রোর মতো এতেও থাকছে একই এম১ চিপ, ১৬ গিগাবাইট পর্যন্ত র্যাম এবং ২ গিগাবাইট স্টোরেজ, ওয়াই-ফাই ৬, ব্লুটুথ ৫, দুটি ইউএসবি সি থান্ডারবোল্ট পোর্ট এবং হেডফোন জ্যাক। বাড়তি পাওয়া, এইচডিএমআই ২ পোর্ট এবং দুটি ইউএসবি এ পোর্টের সঙ্গে একটি গিগাবাইট ইথারনেট পোর্ট।
এটির মূল্য শুরু হবে ৬৯৯ ডলার থেকে।
যেসব অ্যাপের মধ্যেই আছে
মজার বিষয়, এর মধ্যেই অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে থাকা বেশির ভাগ অ্যাপ এআরএম ম্যাকে চলছে। এমনকি প্যারালালসের মতো ভার্চুয়ালাইজেশন অ্যাপও এতে চলবে। তবে অ্যাডোবির সব সফটওয়্যার এখনো হাজির হয়নি। বাদ পড়েছে বেশ কিছু পুরনো ইন্টেলভিত্তিক অ্যাপও। বুটক্যাম্প করে উইন্ডোজ চালানোর সিস্টেমও আপাতত থাকছে না। তবে যারা ম্যাক ভক্ত, তাদের সফটওয়্যার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। অ্যাপল একটি টুল তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে সহজেই সফটওয়্যার নির্মাতারা অ্যাপ এআরএমভিত্তিক অ্যাপল সিলিকনের জন্য পোর্ট করতে পারবেন। ফলে অ্যাপ সমর্থন নিয়ে ব্যবহারকারীদের ভাবতে হবে না জানিয়েছে অ্যাপল। নির্মাতারাও বলছেন, সিস্টেমটি অত্যন্ত সহজ, বছরের পর বছর নতুন সফটওয়্যারের জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।
ভবিষ্যতে
অ্যাপল সিলিকন এম১ মূলত পোর্টেবল সিস্টেমের জন্য তৈরি ১০ ওয়াটের প্রসেসর। সেটাই যে কার্যক্ষমতা দেখিয়েছে, ভবিষ্যতে অ্যাপল যখন ৬০ বা ১০০ ওয়াটের প্রসেসর তৈরি করবে তখন কী ধরনের কার্যক্ষমতা দেখা যাবে সেটা আপাতত ধারণাও করা যাচ্ছে না। তবে একেবারে যে সমস্যা নেই তা কিন্তু নয়। ম্যাকওএসের বাইরে অন্য কোনো অপারেটিং সিস্টেম ম্যাকে আর চালানো যাবে না। বেশ কিছু ইন্টেল ফিচার এআরএমে না থাকায় পুরনো সফটওয়্যার কোনোভাবেই পোর্ট করা যাবেও না। থান্ডারবোল্টের মাধ্যমে বাড়তি জিপিইউ লাগানোর সিস্টেম এম১ সমর্থন করে না। ফলে ভবিষ্যতে ম্যাক অনেক শক্তিশালী হলেও ব্যবহারকারীরা মনের মতো বাড়তি হার্ডওয়্যার এতে ব্যবহার করতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। যদি ম্যাক হয়ে ওঠে আইফোনের মতোই বদ্ধ একটি প্ল্যাটফর্ম, ডেভেলপাররা হয়তো নতুন করে আবারও লিনাক্সের দিকে ঝুঁকতে পারেন। সময়ই বলে দেবে বিশ্ব টেক দুনিয়ায় আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে!