মুঘল আমলে অভিজাত এলাকা ছিলো রমনা। আর চকবাজার ছিলো ব্যবসা কেন্দ্র। সামাজিক মিলন কেন্দ্র ছিলো এই চকবাজার। চারশ বছর পরেও চকবাজারের চিত্র একই রকম। সারাদেশ থেকে পাইকাররা আসেন এখানে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য মালামাল ক্রয় করে নিয়ে যান। এর ফলে বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা পরিচিত হন।
মুঘল আমলে চকবাজারের গোড়াপত্তন হয়। সেসময়ে সেনাপতি রাজা মানসিংহ মুঘল সম্রাটের হয়ে বিদ্রোহ দমনের জন্য এসেছিলেন পূর্ব বাংলায়। ১৬০২সালে( উইকিপিডিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে), ১৭০২ সালে( মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-১ বইয়ের তথ্যমতে) ভাওয়াল থেকে সদরদপ্তর নিয়ে আসেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং এখানেই গড়ে তোলেন মুঘল দূর্গ। সেই দূর্গের পাশেই তখন গড়ে উঠেছিলো বর্তমানের চকবাজার৷
সেসময়ে চকবাজারকে চৌক বন্দর নামেও ডাকা হতো। মানসিংহের সময়ে চকবাজারের যাত্রা শুরু হলেও ১৭৩৩-৩৪ সালে তাঁর জামাতা দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ বাজারটি পুনঃসংস্কার করেন। মুর্শিদকুলি খাঁয়ের এরপর ওয়াল্টার্স সাহেব নতুন করে চকবাজার তৈরী করেছিলেন।
১৮০৯ সালে চালর্স ডয়লী চকবাজারের বর্ণণা দিয়েছিলেন- পুরোনো চকবাজার “নাখাস” নামে পরিচিত ছিলো। আরবী “নাখাস” এর অর্থ দাস-বিক্রেতা। এ বর্ণণা থেকে ধারনা করা হয় মুঘল আমলে চকবাজার দাস বিক্রির কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত ছিলো। এছাড়াও এখানে আড্ডা দেওয়া, অবসরে সময় কাটানোর জন্য লোকজন আসতেন।
ওয়াল্টার্স সেসময়ে চক এবং এর আশেপাশের দোকানপাট সরিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর পুরো এলাকা ৪৬০ ফুট লম্বা, ৪ ফুট উঁচু এবং ১/২ ফুট চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলেন। চক থেকে ইসলামপুর যাওয়ার সরু রাস্তাটিও তিনি প্রসস্থ করে দেন। চকের সামনে স্থাপন করেছিলেন ঢাকার বিখ্যাত কামান মরিময়। এখানে বিশিষ্ট ওলী হযরত আহমেদ জৌনপুরী( রাঃ) এর মাজার রয়েছে। ১৮৯৯ সালের ২৬ জানুয়ারী ঢাকার সদরঘাটে উনি মৃত্যুবরণ করেন। চকবাজার শাহী জামে মসজিদের দক্ষিন পাশে এই মাজারটি অবস্থিত।
বিশ শতকের শুরুর দিকে রোজার দিনে ইফতারির প্রচন্ড ভীড় থাকতো,যা এখনও বিদ্যমান। চকের মোঘলাই খাবারের সুনাম ও চাহিদা রয়েছে আদিকাল থেকেই। কাচ্চি বিরিয়ানি, দম বিরিয়ানি, নবাবি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, চাপ পোলাও, কাবলি পোলাও,পরোটা, প্যাঁচ পরোটা, হালিম,সুতি কাবাব, বটি কাবাব, জালি কাবাব, শিক কাবাব, কোফতা কাবাব, আস্ত মুরগি ও কবুতরের রোস্ট, খাসির গ্লাসি,মুরগির মসল্লাম, দই বড়া, শাহী জিলাপি, পনির সমুচা, ঝাল সমুচা সহ ৫-৭ পদের শরবত, ফিরনি, জর্দা, শাহী টুকরা, কুলফি মালাই, মনসুর, ঘুগনি, বুট ইত্যাদি হরেক রকমের ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানীরা।
“বড় বাপের পোলায় খায়” চকবাজার ইফতারের মূল আর্কষণ। ঢাকার দূর-দুরান্ত থেকে রমজান মাসে লোকজন এখানে আসেন এই খাবারের স্বাদ নিতে। স্থানীয়দের মতে হাজী শহীদ বাবুর্চি এই বিখ্যাত খাবারের সর্বাধিক পরিচিত কারিগর। ৩৬ রকমের উপকরন এবং ১৮ রকমের মসলা দিয়ে তৈরী হয় এই সুস্বাদু খাবারটি৷
অনেকদিন আগ থেকে বিয়ের সময় নতুন বর চকবাজারের চারপাশ ঘুরে তারপর বিয়ের আসরে ফিরে যেতো। কেউ এক চক্কর, কেউ দুই চক্কর, কেউ কেউ তো সাত চক্করও দিতো। তখন পুরো চকবাজার এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠতো। চকবাজারের চারপাশ ঘুরে সালাম না জানালে বিয়ের নিয়ম অসমাপ্ত থেকে যেতো। আজও এ সময়ে এসে পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারা এই রীতি মেনে চলে। কিন্তু এখন তারা এক চক্করই দেয়।
সেই মুঘল আমল থেকেই অর্থনীতি, সামাজিক এবং সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ স্থান চকবাজার। এখানকার অলি গলিতে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই মুঘল আমলের জৌলুশ।
পুরান ঢাকার এই এলাকাতে পাওয়া যায় না এমন কোন পণ্য নেই। ব্যবসার পাশাপাশি হোসনী দালান, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, শাহী জামে মসজিদ সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।