অন্যের সাহায্য ছাড়াই তোলা নিজের ছবিকে সেলফি বলা হয়। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো সেলফি শব্দটি অক্সফোর্ড অভিধানে যোগ করা হয়। সেখানে যা বলা হয়েছে, তার বাংলা হল— সেলফি (বিশেষ্য) নিজেই তোলা নিজের ছবি, যা সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েব ক্যাম ব্যবহার করে তোলা হয় এবং সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহার করা হয়।
প্রথম সেলফি তোলা হয়েছিল ১৮২ বছর আগে। ১৮৩৯ সালে প্রথম সেলফি তুলেছিলেন ৩০ বছর বয়সী রসায়নবিদ রবার্ট কর্নেলিয়াস। নিজস্বী অবশ্য তখনও ‘সেলফি’ নাম পায়নি। ওই রসায়নবিদও ভাবতে পারেননি, ভবিষ্যতে তিনি চিত্রগ্রাহক হিসেবে নাম করবেন। বাবা ছিলেন রূপার কারিগর। ফিলাডেলফিয়ায় পারিবারিক ঝাড়লণ্ঠনের ব্যবসাও ছিল তার। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রথম সেলফি গ্রাহক এই রবার্টই।
ছবিতে এলোমেলো চুলের এক যুবককে দেখা যাচ্ছে। যার হাত দুইটি বুকের কাছে রাখা। দৃষ্টি সরাসরি ক্যামেরার দিকে নয়। ফ্রেমের মাঝখানে না থেকে কিছুটা একপাশে রয়েছেন তিনি। সাধারণত নিজস্বীতে যেমনটা হয়ে থাকে।
ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটির নিচে লেখা, ‘বিশ্বের প্রথম আলোকচিত্র যেখানে আলাদা করে আলোর ব্যবহার করা হয়েছে, ১৮৩৯।’
রুপার পাত দিয়ে মোড়া তামার প্লেটে ছবি তোলা হত তখন। পাতটিকে আয়নার মতো ঝকঝকে পালিশ করা হত যাতে আলোর প্রতিফলন ভালো হয়। আলো ভালো পড়লে ছবিও ভালো। এই প্রক্রিয়াকে বলা হত ড্যগেরোটাইপ ফোটোগ্রাফি।
ছবিটি রবার্ট তুলেছিলেন তাদের পারিবারিক ঝাড়লণ্ঠনের দোকানের পিছন দিকে। উজ্জ্বল আলোর জন্য দোকানে ঝোলানো ঝাড়বাতির আলোর ঠিক সামনেই দাঁড়াতে হয়েছিল রবার্টকে। ক্যামেরার লেন্স খুলে টানা ১৫ মিনিট তার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। তার পর ছবি ওঠে।
ড্যাগেরোটাইপ ফটোগ্রাফিতে সে সময় ছবি তুলতে এতটাই সময় লাগত। বেশি সময়ের জন্যই সম্ভবত রবার্টের ‘সেলফি’তে তার দৃষ্টি অসাবধানতাবশত ক্যামেরা থেকে সরে যায়। তবে সেলফি নিখুঁত না হলেও প্রথম সেলফির কৃতিত্ব পেতে অসুবিধা হয়নি রবার্টের।
ফ্রান্সের আর এক ফটোগ্রাফার একই সময়ে সেলফি তুলেছিলেন। রবার্টের থেকে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে। তার নাম হিপোলাইট বায়ার্ড।
সাজানো গোছানো ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে নানা ভঙ্গিমায় সেলফি তোলা এখন নতুন বিষয় নয়। তবে সেলফি নিয়ে প্রথম এমন সৃষ্টিশীল হয়েছিলেন বায়ার্ডই। প্রথম ‘স্টেজড সেলফি’ অর্থাৎ সাজিয়ে গুছিয়ে মঞ্চস্থ করা সেলফি তুলেছিলেন তিনিই। একজন মৃত মানুষের ভূমিকায় নিজেকে সাজিয়ে সেই ছবি নিজেই ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন বায়ার্ড।
বায়ার্ডের ছবি তোলার প্রক্রিয়া ছিল রবার্টের থেকে একেবারেই আলাদা। সেই প্রক্রিয়ার বিষয়ে ১৮৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সকে জানিয়েওছিলেন তিনি। অ্যাকাডেমি তার আবিষ্কারটি আগে প্রকাশ করলে হয়তো বায়ার্ডই হতেন প্রথম পোট্রেট চিত্র গ্রাহক। কিন্তু ফ্রান্সেরই আরেক চিত্রগ্রাহকের প্রতি পক্ষপাতিত্ববশত অ্যাকাডেমি বায়ার্ডের আবিষ্কারকে মান্যতা দিতে দেরি করে।
বায়ার্ডের ওই ছবির মাস কয়েক আগেই রবার্ট নিজের ছবিটি তুলেছিলেন। পরে অবশ্য রবার্ট আমেরিকায় নিজের ছবি নিজে তোলার একটি স্টুডিও তৈরি করেছিলেন। যেখানে সমাজের ধনী মানুষেরা ছবি তুলতে আসতেন। পোট্রেট তোলার ক্ষেত্রে রিফ্লেক্টর বা আলোর প্রতিফলকের ব্যবহারও ওই স্টুডিওতেই চালু করেছিলেন রবার্ট।
১৯১৩ সালে আয়নায় সেলফি তোলেন রাশিয়ার রাজ পরিবারের কন্যা গ্র্যান্ড ডাচেস অ্যানাসটেসিয়া নিকোলাভানা। রাশিয়ার শেষ জারের কনিষ্ঠা কন্যা ছবিটি তোলেন কোডাকের ক্যামেরায়।
১৯০০ সালে কোডাক তাদের ক্যামেরা কোডাক ব্রাউনি এনেছিল বাজারে। এখানে বলে রাখা দরকার, ব্রাউনি কিন্তু কোডাকের প্রথম ক্যামেরা নয়। ১৮৮৮ সালে কোডাক তাদের প্রথম ক্যামেরা এনেছিল। তবে ব্রাউনি অল্পদামে সাধারণের নাগালে পৌঁছে দিয়েছিল ক্যামেরাকে। ১৯১৩ সালে সেই ক্যামেরার সাহায্যেই আয়নায় সেলফি তোলেন রাশিয়ার রাজকন্যা।
১৯৬৬ সালে মহাকাশে তোলা বাজ অলড্রিনের ছবিটিও ঐতিহাসিক। জেমিনি ১২ মহাকাশ অভিযানে নিজস্বী তুলেছিলেন বাজ। মহাকাশে তোলা প্রথম সেলফি সেটিই।
‘সেলফি’ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয় ২০০২ সালে। নাথান হোপ নামে এক অস্ট্রেলীয় যুবক নিজের ঠোঁট জখম হওয়ার পর তার ছবি তুলে নেট মাধ্যমে দিয়েছিলেন। বিবরণে লিখেছিলেন, ‘ঝাপসা ছবির জন্য দুঃখিত। এটা আসলে সেলফি ছিল।’
সেলফি ক্যামেরা অবশ্য স্মার্টফোনে চালু হয় ২০১৩ সাল থেকে। মূলত ভিডিও কলের সুবিধার জন্যই ওই ক্যামেরা দেওয়া হলেও, তাকে সেলফি তোলার জন্যও ব্যবহার করতে শুরু করেন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা।