বাংলাদেশ চিরসবুজের দেশ। এদেশের পতাকার দিকে তাকালেই আমরা ও ভিনদেশিরা তা আন্দাজ করতে পারি । গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে আমরা যখন ইটপাথরের দেয়ালগুলোতে চোখ রাখি দেখতে পাই বিভিন্ন ইনডোর ও আউটডোর প্ল্যান্ট । আমার দেশের বিভাগীয় জেলাগুলোতে শহর লেভেলে দেখা যায় প্রচুর পরিমাণে নার্সারি । বাংলাদেশের মাটি এতোটাই উর্বর যে নার্সারি নিয়ে কোনো ভোগান্তি নেই ।
কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য যাই বলি না কেনো বর্তমান সময়ে নার্সারির ভূমিকা অপরিসীম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) আওতায় প্রথম নার্সারির যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। এ থেকেই সফলতা দেখে বেশ কিছু উদ্যোক্তা উদ্যোগ গ্রহণ করেন নার্সারির এবং তাদের সফলতা দেখে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার ও প্রদান করা হয় তাদের।এখন বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের নিবন্ধনকৃত নার্সারির সংখ্যা ১৮০০০টির বেশি। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এ খাতের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা যায় ।
বাংলাদেশ কৃষির একটা অংশ হিসেবে আমি আমার জেলা টাংগাইলকে মনে করি ।টাংগাইল জেলায় একটা সময় গাছপালা বলতে আমরা শুধু মাত্র শহরের ওই ছোট হর্টিকালচারের নাম জানলেও উপজেলা শহরের অনেকেরই সম্ভব হতো না সেখান থেকে গাছ সংগ্রহ করে বাগান করার । কিন্তু দিনকে দিন দেখা গেছে হর্টিকালচারের অবস্থা খারাপ হলেও এগিয়ে গেছে জেলা উপজেলায় বিভিন্ন নার্সারি। সফলতার মুখ দেখেছে বিভিন্ন পরিবার ।
ইথিওপিয়ার কফি চাষ
আড্ডার সঙ্গী কি হবে চা নাকি কফি এটা নিয়ে প্রায়ই আমার মাঝে দ্বিধাবোধ হয় ,যদিও আমি চায়ের থেকে কপি বেশি প্রেফার করি । ইথিওপিয়ায় কফির জন্ম হলেও এখন বাংলাদেশের রাজধানী ছাড়িয়ে জেলা শহরের গন্ডি পেরিয়ে এখন কফির চাষ হচ্ছে টাংগাইল জেলার মধুপুরে । বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মহিষমারার ছেলে সানোয়ার হোসাইন কফির চাষ করে সফলতার মুখ দেখতে চান ।এই কফি মধুপুরে শুধু চাষের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে এর চারাও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন নার্সারিতে এছাড়াও উপজেলা কৃষি অফিস থেকেও সংগ্রহ করা যাবে বলে জানা যায় ।
মালটা চাষ
বাংলাদেশের মাল্টা একটা সময় টক হবে বলেই সবার ধারণা ছিলো । কিন্তু এখন সবাই দেশীয় মাল্টায় ঝোঁক দিয়েছেন।মাল্টার চারা এখন পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিছু নার্সারি তে । এছাড়াও আমরা হাতের নাগালেই পেয়ে যাচ্ছি সবকিছু ।
এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ফুল ও ঔষধি গাছের চাষাবাদ।গাছ লাগানোর কথা মনে হলেই কি গাছ লাগাবো,কোথা থেকে সংগ্রহ করবো এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা থাকলেও এখন সবকিছু হাতের নাগালে ।সফল কিছু মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় ,তারা নতুন জীবন দেখতে পেয়েছে এই নার্সারি ব্যবসায় এসে ।যেমন ,মধুপুর উপজেলার অরণখোলা ইউনিয়নের কাকরাইদের সুমি নার্সারির মালিক ওমর শরীফ ।একটা সময় বেশ খারাপ অবস্থায় দিনপাত চললেও এখন তিনি প্রায় ৩২ বিঘা জমির ওপর প্রায় ৩শ প্রজাতির গাছ নিয়ে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল নার্সারি।
এমন কোনোদিন হয়নি আমি তার কাছে গিয়ে হতাশ হয়েছি ।
জলছত্র বাজার কে টাংগাইল জেলা ও এর বাহিরের মানুষজন একটা বিশাল বাজার বলে থাকেন। এখানে সপ্তাহের প্রায় দিনই প্রচুর পরিমাণে ভির জমে বিভিন্ন ফলের। কিন্তু এই জলছত্র শুধুমাত্র কেনাবেচা তেই থেমে নেই এবং ছিলো না । এখানে আগে থেকেই চেষ্টা করা হয় মানুষ গড়ার ।১৯৮৮ সালে যখন ওমর শরীফ সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে,দিন কিভাবে যাবে সেসব নিয়ে ভাবছেন তখনই জলছএ এর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কাকরাইদসহ বিভিন্ন এলাকার ৪৬ জনকে প্রশিক্ষণ দেন । সেখানে ওমর শরীফ বনায়ন বা নার্সারির ওপর প্রশিক্ষণ নেন এবং তিনদিনের ভাতা পান ১৭০ টাকা ।সেই টাকা দিয়েই শুরু নার্সারির ।
সেই দিনের হতাশ ওমর শরীফ আজ বিভিন্ন কৃষিমেলায় স্টল নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করে ও ভিন্ন টাইপ তারা গাছের চারা উৎপাদনের জন্য নিজ উপজেলার প্রশাসন থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়েও সুমি নার্সারির নাম তুলে ধরার সুযোগ হয় । আলহামদুলিল্লাহ।
তেমনি ভাবে আমরা একটা কথা প্রায়ই শুনে থাকি শিক্ষিত মানুষের আবার কৃষি কাজ কিসের !!
এই কথাকে টেক্কা দিতেই সেদিন নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার এতো এতো সার্টিফিকেট একদিকে রেখে মাঠে নেমেছিলেন সুলতান নামের একজন ।যার পুরোবাড়ির চারপাশে বাঁশঝাড়ের জঙ্গল থাকলেও সেসব কেটে শুরু করেন লেবুর চাষ ।লেবু চাষাবাদ করার পাশাপাশি তার মেধা কে কাজে লাগিয়েই একটু ভিন্ন টাইপ কিছু তারা সংগ্রহ করতে চান ।
বেশ কিছুদিন শ্রম দিয়েই তিনি তার নার্সারিতে এখন সুন্দরবনের কিছু চারা রেখেছেন পরীক্ষা মূলক ভাবে কাজে লাগিয়ে এর ফলন দেখার জন্য । এছাড়াও রেখেছেন কফির চারা ।যা চাষ করে অলরেডি আমাদের টাংগাইল জেলার মধুপুর উপজেলার একজন আলোর মুখ দেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ।
এছাড়াও পিরোজপুরের সুলতান মিয়ার নার্সারিতে রয়েছে প্রায় শতাধিক ফলের চারা । সিজনে তার বাগানের আমের চারা থেকেই তিনি লাখ লাখ টাকার আম বিক্রি করে থাকেন বলে জানান ।
শুধুমাত্র ফুল চাষের কথা যদি বলি ,রানিআদ এর আমিনা নার্সারির কথা না বললেই না ।উনি জানান ফুলের খুব শখ থাকলেও তিনি খুজে পাননি পছন্দ মতো গোলাপ গাছ ।এছাড়াও সংসারের টানাপোড়েন তো চলছিলোই ।তাই নিজের সেই ছোট জমিতেই শুরু করেন গোলাপের চাষ । শীতের সকালে বিভিন্ন স্কুলের সামনে দাঁড়াতেন হাতে চার পাঁচটা গাছ নিয়ে। মুহুর্তের মাঝে যেনো ছাএছাএীরা নিয়ে নিতো ।
দিন বদলাতে থাকে ।তিনি গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন ।একটা সময় তার নার্সারি পরিণত হয় ভাম্যমান নার্সারিতেও । সপ্তাহের শুক্রবার তিনি বিভিন্ন বাজার সহ গ্রামে গ্রামে গাছ বিক্রি করেন ।যেনো গাছ পাগল মানুষরাও নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারে । সবশেষে তিনি খুব খুশি মনেই জানান আমি চেয়েছিলাম কাটাজাতীয় এই ফুল সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে।এখন আমি তা পারি ,কেউ যেকোনো কালার চাইলে আমি হেসে বলতে পারি অবশ্যই আছে ।আজ আমি খুশি।
অল্প মূলধন ,মেধা ও শ্রম হয়েছে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী ।তরুণ সমাজ এখন কিছু করতে না পেরে এতো দ্রুত হতাশ হয়ে যায় যে তা আমাদের চোখেই দেখা ।অল্প মূলধনের এই নার্সারি ব্যবসা হতে পারে আমাদের দেশ ও জেলার সেরা শিল্প ।টাংগাইল জেলার মাটি দোআঁশ মাটি হওয়ায় গাছ ও কৃষির জন্য অনেক বেশি ভালোও বটে ।
গাছ লাগান , পরিবেশ বাঁচান স্লোগানে আমরা মুখরিত করতে চাই সবসময় ।তাই এমন উদ্যোক্তাদের আরো সাপোর্ট করে এভাবেই জানিয়ে দিতে চাই আমাদের তথ্য। ই-কমার্সএর মাধ্যমে প্রচার হলে এসব সেকটর এ উঠে আসবে অনেক উদ্যোক্তা।
ধন্যবাদ
আমিনা আতকিয়া
অপরাজিতা