টাকার বিনিময়ে করোনা টিকার ভুয়া সনদ প্রদান, সুরক্ষা অ্যাপ ক্লোন করা- এসব জালিয়াতি পুরোনো। গত কয়েক মাসে এ ধরনের জালিয়াতিতে জড়িত একাধিক চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এবার মিলেছে পিলে চমকানো তথ্য। একটি সংঘবদ্ধ চক্র ‘সুরক্ষা অ্যাপে’র নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ওই চক্রটির হাতে রয়েছে সরকারি জরুরি গুরুত্বপূর্ণ এই অ্যাপের গোপন পাসওয়ার্ড। কেউ টিকা না নিলেও টাকার বিনিময়ে তাঁরা করোনার টিকা গ্রহণের আসল সনদ সরবরাহ করতে সক্ষম। সরকারি অতি গুরুত্বপূর্ণ এই অ্যাপে টিকাগ্রহণকারী হিসেবে যে কারও নাম তাঁরা সংযুক্ত করতে পারেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার মনিটরিং বিভাগের একটি দলের কাছে প্রথমে ডিজিটাল জালিয়াতির এই তথ্য ধরা পড়ে। এর পর থেকে ইন্টারনেটের গোপন দুনিয়ায় অনুসন্ধান চালানো শুরু করে তারা। তদন্তে তারা নিশ্চিত হয়েছে, সুরক্ষা অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ কিছু অসাধু লোকজনের হাতে রয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতো তাঁরাও যখন-তখন ওই অ্যাপে হানা দিতে পারেন।
অনুসন্ধানে কারা, কীভাবে এর সঙ্গে জড়িত এর আদ্যোপান্ত বের হচ্ছে। হ্যাকিং, ডার্কনেট বা ডার্কওয়েব, নাকি সরকারের কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে পাসওয়ার্ড পেয়ে করোনার টিকা নিয়ে ইন্টারনেটে জালিয়াতির হাট বসানো হয়েছে, সে ব্যাপারে চলছে বিশদ অনুসন্ধান। সংশ্নিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে এসব তথ্য জানান।
ডিবির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডিআইজি হারুন-অর-রশীদ বলেন, সুরক্ষা অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জালিয়াতি করার কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন তাঁরা। ইন্টারনেটে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, সুরক্ষা অ্যাপে এই ধরনের জালিয়াতির তথ্য এখনও তাঁরা জানেন না। তবে টিকাগ্রহণকারীদের তথ্য আপলোডকারীদের কিছু অনিয়মের তথ্য তাঁরা বিভিন্ন সময় পেয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কেউ জালিয়াতির মাধ্যমে সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ নিলে তা আইসিটি বিভাগ দেখবে।
সাইবার জগতে নজর রাখেন এমন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এই চক্রটি হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জালিয়াতি করছে। ইন্টারনেটের গোপন মাধ্যমে তাঁরা চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। প্রতারক চক্রটি নিশ্চয়তা দিচ্ছে, শরীরে টিকা না নিয়েও অনলাইনে টিকা এন্ট্রি দেখাতে পারবে তারা। শরীরে টিকা নিয়েছেন, কিন্তু অনলাইনে নিবন্ধন হয়নি তাও এন্ট্রি করে দেওয়া সম্ভব। এমনকি এন্ট্রি করার সময় কারও প্রয়োজন হলে টিকারও নাম বদলে নিবন্ধনও করানো হয়।
ইন্টারনেটে আরেকটি বিজ্ঞাপনে তাঁরা বলছেন, কারও প্রয়োজন হলে সুরক্ষা অ্যাপে টিকা নিবন্ধনকারীর পাসওয়ার্ডও তাঁরা বিক্রি করেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের পাসওয়ার্ড সেট করার নিয়মও শেখান তাঁরা। ঢাকাসহ ৩৬টি জেলায় টিকা নিবন্ধনের পাসওয়ার্ড লাগলে ইনবক্সে যোগাযোগেরও পরামর্শ দেন তাঁরা।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এর আগে কয়েকটি চক্র বিদেশগামীদের হাতে টাকার বিনিময়ে করোনার ভুয়া ও জাল সনদ তুলে দেয়। এতে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি খাতে দুর্নাম হচ্ছে। এবার করোনার টিকা না নিয়েও অনেকের হাতে আসল সনদ চলে যাওয়ায় দেশ ও দেশের বাইরে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
অনলাইনে যেসব প্ল্যাটফর্ম থেকে এই ধরনের জালিয়াতি হচ্ছে, এর মধ্যে কয়েকটি সমকালেরও নজরে রয়েছে। এর একটি হলো, ‘ফলোয়ার সেল গ্রুপ-৭’। সেখানে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারকরা বলছেন, ‘কাজ চলছে বিদ্যুতের গতিতে। কাজ থাকলে ইনবক্সে নক দেন, সার্ভিস একদম ফাস্ট।’ পেছনের তারিখ দিয়ে দুই ডোজ টিকা নেওয়ার সনদ দেওয়া হয়। করোনা টেস্টের ‘নেগেটিভ-পজিটিভ’ সনদও পাওয়া যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইন্টারনেট জগতে করোনার টিকা নিয়ে যে ফাঁদ পাতা হয়েছে তাতে অনেকে জেনেশুনে পা দিচ্ছেন। কেউ আবার না বুঝেই ওই চক্রের খপ্পরে পড়ছে। টিকা না নিয়েও যাঁরা অর্থের বিনিময়ে টিকাদানের মিথ্যা দলিল নিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলছেন। প্রতারকদের মূল লক্ষ্য, প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।
আরেক কর্মকর্তা জানান, সুরক্ষা অ্যাপের সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া চক্রটি জালিয়াতি করে এনআইডি তৈরি, জন্মসনদ বের করা, যে কোনো সিমের বায়োমেট্রিক তথ্য সরবরাহ করারও বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ইন্টারনেটে। জন্মনিবন্ধনে নাম সংশোধনের জন্য নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৬০০ টাকা। এই চক্রে থাকা কয়েকজনের ব্যাংকিং হিসাব নম্বরে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। আয়ের সঙ্গে ব্যাংকে থাকা অর্থের গরমিল পাওয়া গেছে।
কেন প্রতারক চক্র এ ধরনের দুঃসাহস দেখাচ্ছে- এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, জড়িতদের অনেকের ধারণা, এই ধরনের প্রতারণা করলেও খুব বেশি শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না। গ্রেপ্তারের পর কারাগারে গেলে আবার জামিনে বেরিয়ে এসে একই কাজ করা যায়।
এর আগেও করোনার টিকা নিয়ে জালিয়াতির ঘটনায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনেকের নাম উঠে আসে।