তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মীদের জন্য ২০২২ সালটা সুখের ছিল না। কেননা এ বছর পৃথিবীর বৃহৎ কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গণহারে কর্মী ছাঁটাই করেছে। এই তালিকায় আছে টুইটার, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা এবং বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন ডটকম।
টুইটার কিনে গণহারে ছাটাই করলেন ইলন মাস্ক
টু্ইটার কেনা নিয়ে কম জল ঘোলা করেননি শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক। জনপ্রিয় এই মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম কেনার ঘোষণা দিয়েও সরে এসেছিলেন। এমনকি এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি কেনার জন্য পারফিউম বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহেরও ঘোষণা দেন। অক্টোবরের শেষদিকে ইলন মাস্ক শেষ পর্যন্ত ৪৪০০ কোটি ডলারে টুইটার কিনে নিলেন।
টুইটার হস্তগত করার পর খরচ কমানোর জন্য টুইটারে কর্মরত ৭ হাজার ৫০০ কর্মী থেকে অর্ধেক ছাঁটাই করার কথা জানান। প্রথমেই কোপ পড়ে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কমকর্তা (সিইও) পরাগ আগরওয়ালের ঘাড়ে। টেসলাখ্যাত ইলন মাস্ক নিজেই বসলেন সেই চেয়ারে। এরপর একে একে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কর্মী প্রতিষ্ঠানটি থেকে চাকরি খুইয়েছেন।
টুইটার কেনার পর থেকেই মাস্কের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্ল্যাটফর্মটিকে অস্থির করে তোলে। কর্মীদের ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে চাকরির থেকে বরখাস্তের কথা জানানো হয়। চাকরি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন টুইটারে কর্মরত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কর্মীরা।
এই ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে ক্যালিফোর্নিয়ার ফেডারাল কোর্টে মামলা করেছেন কয়েকজন কর্মী। মার্কিন আদালতে এসব মামলা বিচারাধীন। মামলার অভিযোগপত্রে চাকরি হারানো কর্মীরা লিখেছেন, আইন অনুযায়ী ছাঁটাই করার আগে ৬০ দিনের নোটিশ দিতে হয়। এক্ষেত্রে টুইটার সেই আইন মানেনি। কর্মীদের এই অভিযোগের জবাবে ইলন মাস্ক এক টুইটে জানিয়েছিলেন, ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের ৯০ দিনের বেতন দেওয়া হয়েছে। মার্কিন শ্রম আইন মেনেই কর্মী ছাঁটাই হয়েছে।
টুইটারের ঝড় ‘মেটা’তেও
টুইটারের পর ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটায়ও শুরু হয় অস্থিরতা। এই বুঝি চাকরি গেলো! এমন শঙ্কায় কর্মীরা দিন পার করে। এরই মাঝে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ফেসবুকে গণছাঁটাই শুরু হয়ে যেতে পারে। যদিও এই বিষয়ে মার্ক জাকারবার্গ কিংবা তার প্রতিষ্ঠান মেটা অনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
সম্প্রতি মার্কিন শেয়ার বাজারে মেটার শেয়ারের দামে ব্যাপক পতন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বৃদ্ধি, টিকটকের মতো সংস্থার কাছ থেকে বিপুল প্রতিযোগিতা ও অ্যাপলের মতো সংস্থার কাছ থেকে গ্রাহকের গোপনীয়তার বিষয়ে ধাক্কা খেয়ে এখন খুব ভালো অবস্থায় নেই মার্ক জাকারবার্গের প্রতিষ্ঠানটি। এই পরিস্থিতিতে মেটাভার্সের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন। তাই খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই ছাড়া উপায় নেই মার্কিন সংস্থাটির হাতে।
metaচলতি বছর জুনে অন্তত ৩০ শতাংশ কম ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল মেটা। সেই সময় অর্থনৈতিক মন্দার জন্য কর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। ইতিমধ্যে মেটা প্রধান মার্ক জাকারবার্গ কর্মী ছাটাইয়ের আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, সম্ভবত কোম্পানিতে এমন এক গুচ্ছ লোক রয়েছেন যাদের এখানে থাকা উচিত নয়।
এক ব্লগ পোস্টে জাকারবার্গ আরও বলেন, আমি কোম্পানির ইতিহাসে আমাদের করা কিছু সবচেয়ে কঠিন পরিবর্তন শেয়ার করছি। আমি আমাদের দলের আকার প্রায় ১৩ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ফলে আমাদের ১১ হাজার প্রতিভাবান কর্মচারীকে যেতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাকারবার্গ পরবর্তীতে কর্মী ছাটাই না করলেও নতুন করে নিয়োগ স্থগিত রেখেছেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে কোম্পানির আকার ছোট হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন।এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেটায় ৮৭ হাজারের বেশি কর্মী ছিলেন।
১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা অ্যামাজনের
টুইটারের ফেসবুকের পর অ্যামাজন ডটকমে গণছাঁটাইয়ের দামামা শুরু হয়। আমেরিকান এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে ১০ হাজারেরও বেশি কর্মী ছাটাই করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি খরচ কমানোর জন্য আরও বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ।
অ্যামাজনের বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর সর্বপ্রথম মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশ্যে আনে।গণমাধ্যম দুইটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, অ্যামাজন থেকে চলতি বছরেই ১০ হাজারেও বেশি কর্মী ছাটাই করা হবে। বিশ্বজুড়ে অ্যামজনে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ কাজ করেন। কর্মী ছাটাইয়ের খবর সত্যি হলে এটাই হবে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণছাঁটাই।
নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অ্যামাজনে হিউম্যান রিসোর্স, ডিভাইস ইউনিট এবং রিটেল ডিভিশন থেকে কর্মী ছাঁটাই করা হবে। ডিভাইস ইউনিট তৈরি করেছিল অ্যামাজনের সবচেয়ে আলোচিত ডিভাইস অ্যালেক্সা। বাজারে যা বিশেষ সাফলতা পায়নি।
গত কয়েক মাসে অ্যামাজনের কিছু অলাভজনক বিভাগের কর্মীদের ছাঁটাইয়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মধ্যেই অন্য বিভাগে সুযোগ খোঁজার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কিছু কর্মীকে।
করোনা মহামারির সময়ে অ্যামাজানের মতো অনলাইন কেনাবেচার প্ল্যাটফর্মগুলোর দিকে ঝুঁকেছিলেন সাধারণ মানুষ। ফলে তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ফের অতিমারি-পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে গিয়েছে বিশ্ব। অ্যামাজনে কেনাকাটার হার তাই তুলনামূলক কমেছে।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অ্যামাজন এত বড় কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত কখনো নেয়নি।
এদিকে অ্যামাজনের সিইও অ্যান্ডি জেসি জানিয়েছেন, তাদের কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া ২০২৩ সাল অর্থাৎ আগামী বছরও চালু থাকবে। অর্থাৎ আরও কর্মী ছাঁটাই করবে অ্যামাজন।
এদিকে পুরনো কর্মী ছাঁটাই করে নতুন কর্মী নেওয়ার ঘোষণায় আমেরিকার এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটির ভেতরে-বাইরে সমালোচনা হচ্ছে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
অ্যামাজনের ওয়েব সার্ভিস সেল এবং মার্কেটিং টিমের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাট গারম্যান জানিয়েছেন, অ্যামাজন ওয়েব সিরিজ বিজনেসে নতুন করে কর্মী নেওয়া হবে। নতুন কর্মী নিয়োগ করা হবে আগামী বছর। এবছর কোনো কর্মী নিয়োগ করা হবে না।