বাংলাদেশে ১৫ আগস্ট সাইবার হামলার হুমকি দিয়েছিল ভারতীয় একদল হ্যাকার। এরপর থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়। জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভার বন্ধ রাখা হয় ৩৮ ঘণ্টা। যদিও নির্বাচন কমিশনের দাবি, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সার্ভার বন্ধ রাখা হয়েছে। এত সতর্ক থাকার পরও হ্যাকাররা দাবি করেছেন, সাইবার আক্রমণ করে বাংলাদেশে ২৫টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে তথ্য চুরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪০ হাজার রেকর্ডেড তথ্য দখলে নিয়েছে তারা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি কর পোর্টাল থেকেও কিছু তথ্য ফাঁস করেছে হ্যাকাররা। বিভিন্ন পুলিশ ইউনিট, টিকেটিং ওয়েবসাইট ও ব্যাংকের ওয়েবসাইট, আইসিবি ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসের তথ্য ফাঁস হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবি অস্বীকার করা হয়েছে।
অন্যদিকে এখন পর্যন্ত কোনো হামলার ঘটনার কথা জানায়নি সরকারের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা প্রকল্প বিজিডি ই-গভ সার্ট। এটি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) একটি প্রকল্প। গত মঙ্গলবার বিকালে বিজিডি ই-গভ সার্টের পরিচালক সাইফুল আলম খান বলেন, হ্যাকাররা দাবি করতেই পারেন। আমরা এখনও পর্যবেক্ষণ করছি। তথ্য যাচাই না করা পর্যন্ত বলা যায় না যে সেগুলো আসলেই হ্যাকিং কি না। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যেসব সাইট বন্ধ রয়েছে, সেগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক সাইটের আপডেটের কাজ হচ্ছে। অনেক সাইট বন্ধ রাখা হয়েছে নিরাপত্তার জন্য। সাইফুল আলম খান আরও বলেন, আসলে ছয়টি প্রতিষ্ঠানে ডিডস (ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়েল অব সার্ভিস) হামলা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়েবসাইট ঠিক করে ফেলেছে। গুরুতর কিছু হয়নি।
আইসিবির ওয়েবসাইটে প্রায় ১০ হাজার বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগ আবেদনকারীর তথ্য রয়েছে। এ সাইটে এখন প্রবেশ করা যাচ্ছে না। এছাড়া এনআইডি সেবা, সুরক্ষা অ্যাপসহ সরকারের বেশ কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ ছিল। ভারতের হ্যাকারদের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪০ হাজার রেকর্ডেড তথ্য দখলে নিয়েছে তারা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি কর পোর্টাল থেকেও কিছু তথ্য ফাঁস করেছে হ্যাকাররা। আরও যেসব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑবিভিন্ন পুলিশ ইউনিট, টিকেটিং ওয়েবসাইট ও ব্যাংকের ওয়েবসাইট।
সূত্রমতে, গতকাল বুধবার সকাল থেকে এনআইডি সার্ভার বন্ধ থাকায় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাইবার হামলার ঝুঁকি এড়াতে’ এনআইডি তথ্যভাণ্ডার এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা-সংক্রান্ত ওয়েবসাইট সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ুন কবীর গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা মেইনটেন্যান্সের জন্য সাময়িক বন্ধ করেছিলাম। মেইনটেন্যান্স থেকে কিছু তথ্য এলে, কিছু থ্রেট আসতে পারে, তখন বন্ধ করেছি। এ মুহূর্তে কোনো থ্রেট নেই। এখান থেকে ১১৭টি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ নাগরিকরা সেবা পেয়ে থাকে। সব মানুষের নিরাপত্তার জন্য এটা করেছি। এখন সার্ভার ওপেন রয়েছে, সার্ভার থেকে সেবা নিচ্ছে।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সার্ভার বন্ধ রাখার বিষয়টি আগে কেন জানানো হলো না, সেই প্রশ্নে হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘পাবলিকলি না জানিয়ে ১৭১টি প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছিল, যারা এখান থেকে সেবা নিয়ে থাকেন। পাবলিকলি জানালে এটা নিয়ে একটা প্যানিক সৃষ্টি হতে পারে, সে কারণে সবাইকে জানানো হয়নি।’
এদিকে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছে এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ায় গতকাল বুধবার দেশের পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়। ফলে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গড়পড়তা সব খাতের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমেছে। এতে বড় পতন হয়েছে সব কয়টি মূল্য সূচকের। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের গতি। এর মাধ্যমে চলতি সপ্তাহের তিন কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে দরপতন হলো। পুঁজিবাজারে এমন গুঞ্জন ছড়ালেও আইসিবি হ্যাকিংয়ের কবলে পড়েনি বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, আইসিবির ওয়েবসাইট সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। কোনো ধরনের হ্যাকিংয়ের কবলে পড়েনি। অনেকে আইসিবির ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছেন নাÑবিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, এমন অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। এটি ইন্টারনেট ধীরগতি হওয়ার কারণে হতে পার। আবার অনেক সময় দেখা যায় ভাইরাসের আক্রমণ হতে পারে, এমন সতর্কতা দিয়েও কিছু পিসি থেকে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যায় না।
এদিকে দেশের ১৭টি সরকারি ওয়েবসাইটে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশের হ্যাকিং সংগঠন সাইবার ৭১। সাইবার ৭১ সূত্র জানায়, আমরা তাদের আক্রমণের প্রতিবাদে পাল্টা আক্রমণ চালাব। যদি এরপরও তারা দুঃসাহস দেখায় তাহলে অফিসিয়ালি সাইবার যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হবে। আমরা সাইবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই কাজ করব। ভারতের মতো আমরাও মরক্কোর সাইবার স্পেসের মাধ্যমেই এর পাল্টা জবাব দেব, যাতে আর কখনও বাংলাদেশের সাইবার স্পেসে নজর দেয়ার দুঃসাহস না করে।
দেশের সাইবার জগতে হামলা চালানোর হুমকি ও গত মাসে তথ্য ফাঁসের ঘটনার পর সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সরকারের আইসিটি বিভাগের কাছে সহায়তা চেয়েছে। কেউ কেউ সাইবার নিরাপত্তা দল গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা দল বা কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সার্ট) গঠনের কথা জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑনির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোভুক্ত ২৯টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত এক মাসের মধ্যে আইসিটি বিভাগ তিনটি বৈঠক করেছে। সেখানে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি জš§ ও মৃত্যু নিবন্ধনের ওয়েবসাইট থেকে লাখ লাখ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর সাইবার নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারের কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিজিডি ই-গভ সার্ট) ১৫ আগস্ট ঘিরে সাইবার হামলার হুমকি পেয়ে এ মাসের শুরুতে সতকর্তা জারি করে।