হ্যাকিং এবং হ্যাকার শব্দ দুটি দেখলেই যেন কিশোর মনে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। তরুণ প্রজন্মের কাছে অন্যরকম এক অ্যাডভ্যাঞ্চার হলো এই দুটি শব্দ। এইতো কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশে এই শব্দ দুটি খুব বেশি পরিচিত ছিল না। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে হ্যাকিং শব্দটির সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। শুধু পরিচিতই নন, রীতিমতো হ্যাকিংয়ের শিকার থেকে বাঁচতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান খরচ করছে কোটি কোটি টাকা।
সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মতে— ২০২৫ সালের মধ্যে সাইবার সিকিউরিটি ব্যয় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এই হ্যাকিং যারা করেন, তারাই মূলত হ্যাকার। আমাদের আজকের আয়োজন বিশ্বের ভয়ঙ্কর কয়েক হ্যাকারকে নিয়ে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন- আজহারুল ইসলাম অভি
কেভিন মিটনিক:
খ্যাতনামা কেভিন মিটনিক কিশোর বয়স থেকেই হ্যাকিংয়ে হাত যশ তৈরি করেছিলেন। তিনি মার্কিন হ্যাকারদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত একজন হ্যাকার। ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম প্যাসিফিক বেল নামক একটি টেলিফোন কোম্পানির কম্পিউটার ম্যানুয়াল চুরি করেন। এর পরের বছর ঘটান আরো দুঃসাহসী এক কাণ্ড। ১৯৮২ সালে তিনি হ্যাক করেন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নোরাডের নেটওয়ার্ক।
উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধের ঐ উত্তাল সময়ে সোভিয়েত পরমাণু হুমকি থেকে সতর্ক থাকতেই নোরাড তাদের সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। মিটনিকের এ হ্যাকিংয়ের ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় ‘ওয়ার গেমস’ নামক এক চলচ্চিত্র। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুসারে মিটনিক বর্তমানে সফটওয়্যারের দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে সক্ষম বিশেষ প্যাঁচ অনলাইন নিলামে বিক্রি করছেন।
সোলার সানরাইজ:
১৯৯৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইরাকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তখন একদল হ্যাকার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কম্পিউটারের নেটওয়ার্কের ২০টির বেশি সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা সেখানে ‘স্নিফারস’ নামে ট্র্যাপ ডোর টুল ইনস্টল করে দেয়। হ্যাকাররা সান সোলারিস অপারেটিং সিস্টেমে চলমান কম্পিউটারগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নেয়। তাই ঐ সম্মিলিত আক্রমণকে বলা হয় ‘সোলার সানরাইজ’।
অবাক হওয়ার ঘটনা হচ্ছে, হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত কোনো ইরাকি অপারেটিভ ছিল না। মার্কিন সরকার বিষয়টি তদন্তের জন্য এফবিআই এবং ডিফেন্স ইনফরমেশন সিস্টেম এজেন্সি ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা বিভাগকে একত্র করে। তদন্তের ফলে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তিন কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়।
অ্যানোনিমাস:
‘অ্যানোনিমাস’ অর্থাৎ অজ্ঞাতনামা নামে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করছে হ্যাকারদের ছোট্ট এক গ্রুপ। হ্যাকার গোষ্ঠীটি সামাজিক বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। এ লক্ষ্য থেকেই তারা ২০০৮ সালে চার্চ অব সাইন্টোলজি নামে অভিজাত করপোরেট ব্যবসায়ীদের এক ধর্মীয় গ্রুপের নেটওয়ার্ক হ্যাক করে। অ্যানোনিমাস হ্যাকাররা ধর্মীয় গোষ্ঠীটির ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করে দেয়। ফলে গুগল সার্চ র্যাংকিং কমে যায়। এখানেই শেষ নয়, ঐ বছরের মার্চে এখন প্রায় সবার পরিচিত গাই ফক্স মুখোশ পরে পুরো বিশ্বব্যাপী সাইন্টোলজির কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করে একদল ‘অ্যানো’।
নিউইয়র্কার ম্যাগাজিন জানায়, এফবিআই এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অ্যানোনিমাস দলের কয়েক সদস্যকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এর পরও নেতৃত্ব কাঠামোয় সমতা থাকায় অ্যানোনিমাসকে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
ডিনাইয়াল অব সার্ভিস অ্যাটাক:
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ বছর বয়সী মাইকেল ক্যালস ওরফে মাফিয়াবয় দুষ্টুমির ছলে অ্যামাজন, সিএনএন, ইবে আর ইয়াহু ছাড়াও বেশকিছু বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ডিডস (DDoS) আক্রমণ করে বসে- যার নাম দেওয়া হয় ‘ডিনাইয়াল অব সার্ভিস অ্যাটাক’। এর পর তাৎক্ষণিক ভেঙে পড়ে সাইটগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। ধারণা করা হয়, মাফিয়াবয়ের আক্রমণে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ২০০১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন কিশোর বয়সী হওয়ায় আট মাসের জন্য উন্মুক্ত হেফাজতে সাজা দেওয়া হয়।
ম্যাথিউ বেভান ও রিচার্ড প্রাইস:
১৯৯৬ সালে এ দুই ব্রিটিশ হ্যাক করেন বিশ্বের সুরক্ষিত কিছু সামরিক নেটওয়ার্ক। যেসব স্থাপনার নেটওয়ার্কে তারা অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হন- এর মধ্যে ছিল গ্রিফিজ বিমান ঘাঁটি, ডিফেন্স ইনফরমেশন সিস্টেম এজেন্সি ও কোরিয়ান অ্যাটমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (কারি)। ডেটা স্ট্রিম কাউবয়খ্যাত এ দুই হ্যাকার তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডে বিশ্বকে প্রায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণা তথ্য তারা মার্কিন সামরিক নেটওয়ার্কে ডাম্প করলে এই হুমকি তৈরি হয়।
অ্যালবার্ট গঞ্জালেজ:
নিউইয়র্ক ডেইলির এক সংবাদে গঞ্জালেজের নাম দেওয়া হয়েছিলে ‘সুপানাজি’। সেদিন থেকে ওই নামেই তাকে চেনে হ্যাকিং দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ। মিয়ামির একটি হাইস্কুলে পড়ার সময়েই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে আসক্ত কিশোরদের নিয়ে একটি দল গড়ে তুলেছিলেন গঞ্জালেজ। সেখান থেকেই তার পদস্খলন হয় একজন কুখ্যাত সাইবার অপরাধী হিসেবে। সাইবার অপরাধীদের বাণিজ্যিক সাইট শ্যাডোক্রু ডটকমের রীতিমতো সক্রিয় একজন হয়ে ওঠেন গঞ্জালেজ। ওই সময়ে তাকে বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ে পৃথিবীসেরা হ্যাকার বলে গণ্য করা হতো। ২২ বছর বয়সে গঞ্জালেজকে প্রায় ১০ লাখ ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরির দায়ে নিউইয়র্কে গ্রেফতার করা হয়। এরপর কারাদণ্ড এড়াতে তিনি মার্কিন সরকারের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা সিক্রেট সার্ভিসের জন্য একজন তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতে থাকেন।
তবে সাইবার অপরাধীদের লাগাম ধরা মুশকিল। সিক্রেট সার্ভিসের বেতনভোগী ইনফরমার হিসেবে কাজ করার সময় গঞ্জালেজ ও তার সহযোগীরা মোট ১৮ কোটি ক্রেডিট কার্ড অ্যাকাউন্টের তথ্য চুরি করেন। এ সময় টিজিএক্স নামক একটি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি থেকে মোট ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার চুরি করা হয়। ২০১৫ সালে এসব অপরাধে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল কোর্ট তাকে কারাদণ্ড দেন।