চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের হ্যাংজু শহরে আছি ১১ দিন হলো। এই সময়ে গেমসের অনেকগুলো ভেন্যু ও শহরের অনেক দর্শনীয় জায়গায় যাওয়া হয়েছে। শহরের বিভিন্ন অলি-গলি ঘোরা হয়েছে। ট্যাক্সি, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন বাহনে চড়া হয়েছে। যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই দেখেছি চীনের লোকজন মোবাইল থেকে মাথা তুলতে পারেন না।
রেস্তেরাঁয়, হোটেলের ওয়েটিং রুমে, রাস্তার মোড়ে, মেট্রোর ভেতরে কিংবা বাইরে, দাঁড়ানো অবস্থায়, হাঁটতে হাঁটতে অথবা বসে- সব অবস্থাতেই মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকেন চীনের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা।
রেস্তেরাঁয় বন্ধু-বান্ধব পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে বসে খাচ্ছেন, সেখানেও সবাই মোবাইলে ব্যস্ত। রাস্তার পাশে বসে আছে, সেখানেও মোবাইল থেকে চোখ তুলতে পারেন না। হাঁটতে হাঁটতেও মোবাইল চালাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। নতুবা নির্ঘাত ধাক্কা লাগবে।
মেট্রোতে উঠলে সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়। ৮ থেকে ১০ বগির মেট্রোতে যতো চাইনিজ মানুষজন থাকেন তাদের ৯৮ ভাগ মোবাইল থেকে মুখ তুলতে পারেন না। যারা মেট্রোর ভেতরে আছেন তারাও ব্যস্ত মোবাইলে। যারা বাইরে মেট্রোর জন্য অপেক্ষা করছেন তারাও চোখের কাছে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। এক্সিলেটরে কিংবা লিফটে উঠতে উঠতেও মোবাইলে ব্যস্ত সবাই।
এশিয়ান গেমসের ‘প্রধান মিডিয়া কেন্দ্রে (এমএমসি)’ স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন প্রায় হাজার খানেক ছাত্র-ছাত্রী। তাদেরও একই অবস্থা। দিনশেষে তারা যখন বাসায় ফেরার জন্য গেটের সামনে সারিবব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না যিনি মোবাইলে ব্যস্ত নন।
কি করেন তারা? নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে অধিকাংশ স্ক্রলিং করেন। কেউ কেউ ভিডিও দেখেন। কেউ কেউ উইচ্যাটে চ্যাটিং কিংবা টিকটক ভিডিও দেখেন।
চাইনিজরা কেন এতো মোবাইল আসক্ত? স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা, বিল পেমেন্ট থেকে শুরু করে চীনের প্রায় সবকিছু হয় অনলাইনে। সে কারণে মোবাইলের বাইরে তারা যেতে পারেন না। তাদের জীবন এখন অনলাইন নির্ভর। সে কারণে তারা মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়েছে।
তবে তাদের মতে এভাবে মোবাইলে মুখ গুজে থাকাটা ভালো কোনো লক্ষণ নয়। বিষয়টিকে তারা নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
ঝেজিয়াং টেলিভিশনের সাংবাদিক তেতে বলেছেন, ‘আসলে এদের অধিকাংশ মোবাইলে আসক্ত। আর আসক্তি কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না। এভাবে মোবাইল থেকে মুখ তুলতে না পারাটা নিঃসন্দেহে খারাপ কিছুর সংকেত বহন করছে।’
চায়না মিডিয়া গ্রুপে কর্মরত একজন সাংবাদিক বলেন, ‘আমরা আসলে খুবই মোবাইল নির্ভর। আমাদের প্রায় সবকিছু মোবাইলে হয়। প্রযুক্তিতে আমরা মোবাইলের মধ্যে সহজলভ্য করে তুলেছি। সে কারণে মোবাইল ছাড়া আমরা চলতে পারি না। তবে হ্যাঁ, এভাবে মোবাইলে মুখ গুজে থাকা ভালো কিছু না। মেট্রোতে যাদের দেখেছেন, তাদের অনেকে সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ঘরে ফেরার পথে মোবাইলে মগ্ন হয়ে আছে। আবার অনেকে অবশ্য আসক্তির পর্যায়ে আছে। কিন্তু এটা থেকে পরিত্রাণের উপায় জানা নেই আমার।’
চীনের নানজিং তথ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (এআই) নিয়ে পড়াশুনা করা বাংলাদেশি ছাত্র সাকিব চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘চীনারা প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। তারা অত্যন্ত প্রযুক্তি নির্ভর। তাদের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে সবকিছু প্রযুক্তি নির্ভর। সে কারণে তারা ডিভাইসে বেশি সময় ব্যয় করে। তবে এটাও ঠিক অনেকে আসক্ত। আমরা যেমন সবাই একই বাসে কোথাও ঘুরতে গেলে আড্ডা দিই, গান গাই, হই-হুল্লোড় করি। তারা সেটা করে না। তারা মোবাইলে ব্যস্ত থাকে।’
চীন নানা প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রাকে দারুণভাবে সহজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি মানুষকে কাছে রেখেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাইতো একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার সময়ও মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন তারা। কাছের মানুষের পাশাপাশি বসে, মুখপানে চেয়ে দু’চারটা কথা বলার চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে ভেসে বেড়ানোটা তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।