প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেটের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে দেশি-বিদেশি ১০টি কোম্পানি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন করছে। দেশের মোবাইল ফোন সেটের চাহিদার প্রায় শতভাগই উৎপাদন হচ্ছে দেশে। তবে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, মোবাইল সেট উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে এলসি জটিলতাসহ নানা কারণে মোবাইল হ্যান্ডসেটের উৎপাদন তলানিতে ঠেকেছে। মোবাইল খাত-সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসের ব্যবধানে দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। সঙ্গে বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। উৎপাদন ও বিক্রি কমে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় অবৈধ হ্যান্ডসেটের বাজার বাড়বে বলে মনে করেন তারা। কোম্পানিগুলোকে বাঁচাতে এই খাতে নজর দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৮৫ হাজার। এর মধ্যে দেশে টু-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ৭৮ হাজার, ৩-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ৩০টি, ৪-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছিল ৭৫ লাখ ৩২ হাজার, আর ফাইভ-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার।
তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে টু-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৬ হাজার, ৩-জি কোনো হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়নি। তবে ৪-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ৫৭ লাখ ১৯ হাজার। আর ফাইভ-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ৫৪ হাজার ৭১৫টি। অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে মোট ২ কোটি ৪৫ লাখ ৮৫ হাজার। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসে হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার। অর্থাৎ দশ মাসে হ্যান্ডসেট উৎপাদন কমেছে ৫৮ লাখ ৬ হাজার; যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ কম।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে স্মার্টফোন বিক্রি ৪২ শতাংশ কমেছে। এদিকে ফিচার ফোনের বিক্রি গত বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ লাখে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের কর সুবিধার সহায়তায় সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে হ্যান্ডসেটের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল। এরপর দেশে ১৫টি প্লান্ট স্থাপন করা হয়, ফলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। গত অর্থবছরের আগে স্মার্টফোন আমদানিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর দিতে হতো এবং স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর কর দিতে হতো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। কিন্তু, এখন তা বেড়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কারণ কারখানা থেকে শুরু করে পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
আর উৎপাদকদের জন্য আরেকটি ধাক্কা হলো রাজস্ব কর্তৃপক্ষ উৎপাদন পর্যায়ে আরও ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকে সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো ২ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে তৈরি কমপক্ষে দুটি উপাদান দিয়ে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি যন্ত্রাংশ দিয়ে সংযোজিত হ্যান্ডসেটের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এ অবস্থায় কর কমানো অসম্ভব মনে হলে গ্রে মার্কেট নির্মূলে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন শিল্প-সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীদের মতে, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের কারণে একদিকে কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে ডলার ঘাটতি থাকায় এলসি খোলা কঠিন হয়েছে। পাশাপাশি হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ভ্যাটও বেড়েছে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই এই শিল্পে প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, একদিকে দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে হ্যান্ডসেট সাশ্রয়ী না হয়ে প্রাইস বেড়েছে। মানুষ এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ফোন কিনছে না, এক্সচেঞ্জ করছে না। ফলে হ্যান্ডসেটের বাজারেও বড় রকম প্রভাব পড়েছে। আবার গ্রে-মার্কেট (অবৈধভাবে দেশে আসা মোবাইল ফোন) কন্ট্রোল করতে না পারাই বাজারে দেদার অবৈধভাবে হ্যান্ডসেট বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে গ্রে-মার্কেটের আকার প্রায় ৪০ শতাংশ। তাদের সঙ্গে প্রাইস কম্পিটিশনেও পারা যাচ্ছে না। ফলে দেশে উৎপাদিত ফোনের তুলনায় কম দামে ফোন বিক্রি করতে পারছেন। গ্রাহকরাও তো কম দামে তাদের থেকে ফোন সংগ্রহ করছে।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সূত্র জানিয়েছে, মোবাইল ফোনের বাজারের অবস্থা খুবই নাজুক। প্রতিনিয়ত বাজারে ক্রেতা কমছে। কেননা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে। বাজারে ভালো মডেলের ফোন এনেও ক্রেতাদের সাড়া মিলছে না। তবে আমরা এখনও আশাবাদী। বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। ভালো ভালো মডেলের ফোন আনলেই ক্রেতারা ছুটে আসবে। আসলে ক্রেতাদের ছুটে আসার মতো ফোনও বাজারে নেই।
জানতে চাইলে ট্রান্সশান বাংলাদেশের (ইনফিনিক্স, আইটেল ও টেকনো মোবাইলের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান) প্রধান নির্বাহী ও মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি রিজওয়ানুল হক বলেন, ‘ডলার রেট বেশি হওয়ার পাশাপাশি কাঁচামালের বাড়তি দাম, বাড়তি ট্রান্সপোর্টের প্রভাব পড়ায় একদিকে ফোনের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ফোন কিনছে না। অর্থাৎ সব দিক থেকেই দেশের মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রিতে বাজে সময় যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ফ্যাক্টরি ৫০ শতাংশও অ্যাকটিভ না। শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলেও সামনে আমাদের প্রায় অর্ধেক কর্মী ছাঁটাই করতে হবে।’
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম-সম্পাদক জাকারিয়া শাহীদ বলেন, ‘এখন কোনো বিজনেসের অবস্থাই খুব একটা ভালো না। বড় সমস্যা হচ্ছে মানুষের পার্চেজিং পাওয়ার কমে গেছে বা এখনকার পরিস্থিতিতে কেউ এক্সট্রা খরচ করতে চাচ্ছেন না। ডলারের দাম বাড়ায় এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে একই সঙ্গে সাপ্লাই চেইন গ্যাপটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রডাকশনও কমে যাচ্ছে। আসলে এরকম পরিস্থিতি কখনও ওইভাবে ফেস করিনি, তাই এখান থেকে উত্তরণ কীভাবে হবে সেটা ধারণা করে বলাটাও মুশকিল। তবে আমার মনে হয় আগামী বছর ফেব্রæয়ারি-মার্চের আগে এই পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এখন যদি বাংলাদেশ সরকার ডলার রেট ইমিডিয়েটলি ফিক্সড করে দেয় তাহলে হয়তো কিছুটা সমস্যা সমাধান হতে পারে।’