অবৈধ পথে আসা মোবাইল হ্যান্ডসেটে সয়লাব দেশের বাজার। এর ধাক্কায় বিপর্যস্ত দেশে স্থাপিত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কারখানাগুলো। এসব কারখানায় উৎপাদিত হ্যান্ডসেট বিক্রি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।
এভাবে চলতে থাকলে সরকারের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। বিদেশি কোম্পানিগুলোও এক সময় ফিরে যেতে পারে তাদের সমুদয় বিনিয়োগ তুলে নিয়ে। সেই দুশ্চিন্তাই এখন ভর করে আছে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথার ওপর।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৮৫ হাজার। এর মধ্যে দেশে টু-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ৭৮ হাজার, ৩-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ৩০টি, ৪-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছিল ৭৫ লাখ ৩২ হাজার, আর ফাইভ-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার।
তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে টু-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৬ হাজার, ৩-জি কোনো হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়নি। তবে ৪-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ৫৭ লাখ ১৯ হাজার। আর ফাইভ-জি হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ৫৪ হাজার ৭১৫টি। অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে মোট ২ কোটি ৪৫ লাখ ৮৫ হাজার। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসে হ্যান্ডসেট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার। অর্থাৎ দশ মাসে হ্যান্ডসেট উৎপাদন কমেছে ৫৮ লাখ ৬ হাজার; যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ কম।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ২০২০ ও ২০২১ সালেও দেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ৯৮ শতাংশই বিক্রি হয়েছে। পরের বছর ২৫ শতাংশ হ্যান্ডসেট অবিক্রীত থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ বাজারের চাহিদা দেখেই উৎপাদনের ইউনিটসংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এমন নয় যে, দেশের বাজারে আগের চেয়ে হ্যান্ডসেটের চাহিদা কমে গেছে। বরং সেটের চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু বাজারে ভাটার চিত্র অসঙ্গতিপূর্ণ। উৎপাদন ও বিক্রির এত তারতম্য হওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
আর এই পরিস্থিতির নেপথ্য কারণ একটাই, তা হলো- ২০২২ সালজুড়ে দেশে অবৈধ পথে হ্যান্ডসেট ঢুকেছে প্রচুর। সেগুলোর বিক্রিও হয়েছে বেশ। আর এতে মার খেতে হচ্ছে দেশে স্মার্টফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বর্তমানে চরম বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে তারা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে মোবাইল সেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা স্টিকার বিলুপ্তির পথে চলে যেতে পারে।
দেশে হ্যান্ডসেট তৈরির কারখানা উৎসাহিত করতে সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৪৪টি যন্ত্রাংশে বড় ধরনের শুল্ক ছাড় দেয়। দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয় আমদানিকৃত হ্যান্ডসেটের শুল্ক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে আরও ৪৪টি যন্ত্রাংশের শুল্ক কমানো হয়। বিপরীতে বিদেশে তৈরি মোবাইল ফোন আমদানিতে শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এ কারণে একের পর এক বিদেশি কোম্পানি দেশে কারখানা স্থাপন করতে শুরু করে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল হ্যান্ডসেটের দাম যেমন কম, মানের দিক দিয়েও উৎকৃষ্ট। তারপরও বিদেশ থেকে আসা অবৈধ হ্যান্ডসেটের দাপটে দেশীয় উৎপাদন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে অবৈধ পথে আসা হ্যান্ডসেট ফেসবুকে পেজ খুলে ঘোষণা দিয়েই বিক্রি হচ্ছে। ফেসবুক পেজে দেখে রাজধানীর দুটি মার্কেটে সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। দুই জায়গাতেই স্যামসাং ব্র্যান্ডের এস-২২ আল্ট্রা মডেলের হ্যান্ডসেটের দাম চাওয়া হয় ১ লাখ ৪ হাজার টাকা। একটি মার্কেটে দরকষাকষির পর ৪ হাজার টাকা কমিয়ে ১ লাখে দিতে রাজি হন শোরুমের কর্মচারী।
অবৈধ পথে হ্যান্ডসেট বৃদ্ধি ঠেকাতে ২০২১ সালের জুলাই মাসে এনইআইআর (ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্ট্রার) চালু করেছিল বিটিআরসি। সে সময় সিদ্ধান্ত ছিল এনইআইআর ডেটাবেজে আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি) নিবন্ধিত না থাকলে সেসব হ্যান্ডসেটে সিমকার্ড মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কে সচল হবে না। তখন বিটিআরসি নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করত। ফলে সে সময় অবৈধ পথে হ্যান্ডসেট আসার সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বিটিআরসি এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ফলে আবারও অবৈধ পথে হ্যান্ডসেট আসা বেড়ে যায়। এখন বাজারে বিক্রি হওয়া সেটের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই অবৈধ পথে আসা।