মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অনেক বাংলাদেশী কর্মী রয়েছে যারা শুধু ইংরেজিতে কথা বলতে না পারার কারনে অনেক দুর্ভোগের শিকার হয়। এমনি একজন ইরাক প্রবাসি আল আমীনের জীবন বদলে যাবার গল্প শুনুন তার নিজের লেখাতেই ।
আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন দিনমজুর। আমার ৫ম শ্রেণীর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পাথর ভাঙার কাজ করতেন। অত্যান্ত পরিশ্রমী এবং সহজ সড়ল এবং সৎ লোক ছিলেন আমার বাবা। তিনি যতদিন দিনমজুর ছিলেন ততদিন আমাদের পরিবার খুব কষ্টে দিন কাটতো। আমার মনে পড়ে আমার বাবা যখন কাজের খোজে ঢাকায় আসেন আমি তখন ৫-৬ বছরের হবো।
তখন সাড়াদিনে ১ বেলা খেয়ে দিন পার করতাম। অত্যন্ত অভাব এবং কষ্টের মধ্য দিয়ে আমি আমার ছোট বেলা পার করি। যখন তিনি ছোট একটি ব্যাবসা শুরু করেন, তখন থেকে একটু স্বাচ্ছন্দ আসে আমাদের পরিবারে অর্থনৈতিকভাবে। তিনি এতই সহজ সড়ল এবং মনভূলা ছিলেন যে, কারো কাছে বাকিতে পন্য বিক্রি করলে তা মনে থাকতো না।
এতে করে আমাদের অনেক টাকা ঋন হয়ে যায় মহাজনের কাজে। তিনি যার কাছ থেকে মালামাল ক্রয় করতেন তিনি দাবি করেন যে আমার বাবার ৪০ হাজার টাকার মত ঋণ হয়ে গেছে, অথচ আব্বু কার কাছে কতটাকা পান এর কোন তালিকা ছিলো না।
যেহেতু তিনি লিখতে পারতেন না আবার মনেও রাখতে পারতেন না, সেহেতু খুব সমস্যার পড়ে যায় আমাদের পরিবার। এরই ভিতরে আব্বা অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। তখন ২০০৭ সাল, আমি নিজেই প্রচুর পরিমানে টিউশনি করতাম সংসারের হাল ধরার জন্য। সারাদিন একটানা ৬-৭ টি যায়গায় টিউশনি করে মাত্র ২৫০০-৩০০০ টাকা মাসে পেতাম।
যেহেতু গ্রাম, সেহেতু সব কিছুই সস্তায় পাওয়া যায়। আব্বুর ব্যাবসাতেও বসতাম আর মনে খুব কষ্ট লাগতো যে, আমার বয়সি সবাই খেলাধুলা করে আর আমি কাজ করি। মাঝে মধ্যে দারিদ্রতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের অভাবের কথা তুলে ধরতাম। যাইহোক একপর্যায় ২০১২ সালে আমার বাবা অসুস্থ্ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আব্বুর চিকিৎসার জন্য প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা আবারো ঋণ হয়ে যায়।
আমার মা অনেক সহজ সড়ল এবং নরম মনের মানুষ। তিনি সবসময় চাইতেন আমি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হই। কিন্তু দারিদ্রতার কারনে তা আর হয়ে উঠে না। তবে মাঝে মধ্যেই মায়ের মনের কষ্ট বুঝতাম তিনি কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন আমার পড়াশোনা বন্ধ হবার কারনে। আমি ২০০৮ সালে এইসএসসি পাশ করি, মায়ের মনের অবস্থা দেখে আমি ২০১৮ সালে আবার ডিগ্রীতে ভর্তি হই। মায়ের মনের ইচ্ছা পূরন করার জন্য। কিন্তু ৩১ মে ২০১৮ আমাকে ইরাক চলে আসতে হয় পরিবারের দুরাবস্থার কারনে।
ইংরেজী না জানার কারনে আমার জীবনে আমি অনেক সাফার করি। ভাল কোন কাজ পাইনি, আমি আমার লাইফে কম করে হলেও ১০ রকমের পেশার কাজ করি। তবে শুধু নিজের ইংরেজী না জানার কারনে নিজে থেকেই এসব কাজ থেকে চলে আসি। এর মধ্যে দিনমজুরের কাজও করেছি। ভাল ছাত্র ছিলাম না ইংরেজীতে, যার ফলে এসএসসি তে ইংরেজীতে ডি পাই এবং এইচএসসি তে সি পাই। কোনমতে পাশ করি।
যখন বিদেশে আসার জন্য ইন্টারভিওতে গেলাম, আমাকে কোরিয়ান ডেলিগেট ইংরেজীতে কিছু জিজ্ঞাস করে কিন্তু আমি বলতে পারি নাই, তাই আমি টিকি নাই। অনেকটা লজ্জা পাই তখন। যাইহোক যখন আমার বর্তমান কাজের জন্য বিমান বন্দরে আসি দুবাইতে, বিমানবালা আমাকে একটা যায়গায় বসতে বলে কিন্তু আমি ইংরেজী জানি না বলে কথা বলতে পারি নাই। বিমান বন্দরের একটি ওয়াশরুম থেকে আমাকে বের করে দেয়া হয় ইংরেজীতে কথা বলতে পারি নাই বলে। কি লজ্জার কথা। কাউকে বলতেও পারছি না।
তারপর যখন প্রথমদিন আমার কোরিয়ান বস এব ইরাকি দুইজনে আমাকে রিসিভ করার জন্য আমার কাছে আসে। আমাকে ইংরেজীতে হায় হ্যালো করে আমি ভাল করে উত্তরও দিতে পারিনি। অত্যন্ত অপমানিত হতে লাগলাম তখন। অফিসে কাজে সময় যখন বসের সাথে কথা বলতে হতো তখন আমার কলিগ আমার কথাগুলো বসের কাছে ট্রান্সলেট করে দিতো।
সবসময় এমন অপমান লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে দিন কাটতে থাকে। একদিন আমার এই অবস্থা দেখে আমার কলিগ মোঃ সোহাগ আমাকে বলে যে তুমি চাইলে ইংরেজী চর্চা করতে পারো- একটা গ্রুপ আছে। আমি কি তোমাকে এড করবো? আমি ভাবলাম গ্রুপে কি করে চর্চা করা যায়। আমতা আমতা করে বললাম, ঠিক আছে চেষ্টা করবো।
রাস্তা দিয়ে হাটার সময় কিছু নোটিফিকেশন আসে আমার মোবাইলে, কিন্তু আমি দেখিনি। এভাবে মনেহয় ১ মাস পেরিয়ে যায়। আমি কোন চর্চা করি না। শুধু মাঝে মাঝে পোষ্টগুলো দেখতাম আর মন চাইলে লাইক দিতাম। একদিন আমি বগুড়ার নিশা জাহান আপুর পোষ্টে দেখলাম তিনি বিয়ে হবার পর আবারো ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হয় পড়াশোনা করছেন এবং এই গ্রুপ থেকে প্রতিদিন উপকৃত হচ্ছেন। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও চর্চা করবো। তারপর থেকে অল্প অল্প কমেন্ট করতাম।
একপর্যায় সার্চ ইংলিশের প্রতিষ্ঠাতা রাজিব আহমেদ স্যারের পোষ্ট পেলাম, প্রতিদিন ৩০ টি কমেন্ট করার জন্য তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন। তারপর থেকেই ৩০ টি করে কমেন্ট করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কখনো গননা করি নাই। একদিন ভাবলাম গুনবো আজ। ঐদিন ১০৫ টার মত কমেন্ট লিখি। গুড ,ভেরি গুড, থ্যাঙ্ক ইউ, নাইচ এরকম ছোট ছিলো কমেন্টগুলো। লক্ষ্য করলাম তার পর থেকেই বড় করে কমেন্ট লিখতে পারছি, তারপর পোষ্ট লিখতে পারছি।
নিজেকে নতুনভাবে খুজে পাই, আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। তারপর স্যার ভিডিও করে আপলোড করার কথা বলেন সবাইকে। কিন্তু আমি ভিডিও করতে পারি নাই প্রথমে ভয়েতে। যখন মোহাম্মদ আল আমিন, আল ফেরদৌস
রানা,মেহেদি হাসান, সাকিল রবি ভাইয়ারা প্রায় ৫০০+ করে ফেলেন তখন মোহাম্মদ সোহাগ ভাই এবং আমার পাশের রুমের আনোয়ার হোসেন ভাইয়ের উৎসাহে প্রথম ভিডিও করি।
৭-৮ টি ভিডিও থকে যেটা ভাল হয় সেটাই আপলোড করি। এভাবে ভিডিও করতে থাকি। তখন ১০০ ভিডিও করা হয়েছিলো আমার, আমি অনেকটা লজ্জা ও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারি। ১০০ ভিডিও করতে মনে হয় আমার প্রায় ২০ দিন লেগেছিলো। পরেরদিন ডিএসবি গ্রুপে একটি পোষ্ট দেই যে আমি ৪ দিনে ১০০ ভিডিও করবো কামরুল হাসান ভাইয়া কমেন্ট করেন তাতে করে দেখাতে হবে কিন্তু। আমি বললাম হ্যা করবো ইনশাআল্লাহ। সবাই পোষ্টে কমেন্ট করে এত উৎসাহ দিতে লাগলো যে আমি আনন্দিত হলাম অনেক। ৪ দিনে ১০০ ভিডিও করলাম, তার পরের ২ দিনে ১০০ ভিডিও করলাম।
ভিডিও গুলি করতে গিয়ে আমার যখন ঘুম পাচ্ছিলো আমি ঘুমাচ্ছিলাম না। কারন আমাকে আমার কাজ শেষ করে তারপর ঘুমাতে হবে তাই। আমার রুমের লোক উল্টাপাল্টা বলবে বলে বাহিরে থেকে ভিডিও করতাম।
যেদিন আমার ১০০০ ভিডিও সম্পন্ন হয়, তার আগের রাতে আমি সারা রাত বাহিরে দাড়িয়ে ভিডিও করি। তখন বাহিরের তাপমাত্রা ছিলো -৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং শীতে কাঁপছিলাম। কিন্তু আমি ঐদিকে লক্ষ্য না করে ভিডিও করে আপলোড করছিলাম।
রাতে যখন ঘুম পাচ্ছিলো, তখন ঘুমাতে গেলাম। কিন্ত ১ ঘন্টা পরেই ঘুম ভেঙে যায় ঘুমাতে পারছিলাম না। কারন রুমা বেগম আপু এবং নিরা ইমতিয়াজ আপু দুজন যেই স্পিডে যাচ্ছেন। এভাবে স্লো হলে আমি পিছিয়ে যাবো তাই। ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে আবার বাহিরে এসে ভিডিও করতে লাগলাম ২০০+ ভিডিও করি ঐ সাড়ারাত বাহিরে দাড়িয়ে -৩ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে।
অবশেষে ১০০০ ভিডিওতে রুমা আপুর অবস্থান ৭ম এবং আমার অবস্থান ৮ম হয়। তারপরেও ভিডিও করে যাচ্ছিলাম। প্রতিদিন ১০০,২০০,২৫০০ একদিন ৩০০+ ভিডিও করি। একদিন রাতে ভিডিও করতে করতে ঘুমিয়ে যাই, ঘুমের মধ্যে দেখি কে যেনো আমার আগেই ১০ হাজার ভিডিও করে ফেলেছে। ঘুম থেকে উঠে দেখি আলহামদুলিল্লাহ, সেটা ছিলো স্বপ্ন। তবে Tau Hid ভাইয়া আমার খুব নিকটেই ছিলো। আলহামুলিল্লাহ আবশেষে ১০ হাজার ভিডিও করে ২য় হই, প্রথম রুবাইয়া ইসলাম আপু। আমি অনেক খুশি কারন, আমি এখন নিজেই ট্রান্সলেট করার জন্য বসের সাথে বিভিন্ন যায়গায় যাই। অথচ আমার কথাগুলো বুঝানোর জন্য একজন ট্রান্সেলটর লাগতো
সব সম্ভব হয়েছে আমাদের শ্রদ্ধেয় মেন্টর জনাব রাজিব আহমেদ স্যারের জন্য। তিনি যদি সার্চ ইংলিশের মত এমন বিড়াট প্লাটফর্ম তৈরী না করতেন, তবে আমি সাড়াজীবন কাজ করতাম অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে। এমনকি হয়তো আমাকে দেশেও চলে যেতে হতো। চীর কৃতজ্ঞ আমি স্যারের নিকট। আল্লাহ তাআলা ওনাকে সবসময় সুস্থ্য রাখুন এবং স্যারের স্বপ্নগুলো পূরন করুন।
আমি এখন মাসের প্রায় ২০ দিন প্রতিদিন ৬-৭ ঘন্টা সময় দেই বাকি ১০ দিন ২-৩ ঘন্টা সময় দেই। কারন তখন আমার ১২ ঘন্টা ডিউটি থাকে। আমার এখানে নেটেরও একটু সমস্যা। আমরা ১০ হাজার বাংলাদেশী প্রবাসীদের জন্য নেটের সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। সবমিলিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১২ ঘন্টাই নেট চালতে পারি না। এখন প্রায় সময় বাড়িতে যখন কথা বলি তখনো আমি কমেন্ট করি, পোষ্ট পড়ি।
তাই আমি বলবো আমি যেমন স্যারের কথাগুলো ১০% মেনে নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছি। আপনারা আপনাদের মূল্যবান সময়টুকু কাজে লাগান। আমি চেষ্টা করবো ১০০% স্যারের কথাগুলো মেনে চলতে ইনশা আল্লাহ। আর আমি পূর্বে ডিউটি ব্যাতিত ১২ ঘন্টা ঘুমাইতাম বাকি সময় মুভি দেখতাম। কিন্তু এখন ৪-৫ ঘন্টা ঘুমাই।
ঘুমাতে গেলে মনে হয় প্রেক্টিস এর সময় কমে যাচ্ছে। তাই ঘুমও আসতে চায় না।