বিস্ময়কর গতিতে অগ্রসর হওয়া বৈশ্বিক প্রযুক্তির এই জোয়ারে পথ হারানো খুব কঠিন নয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন এক প্রযুক্তি, যেখানে শব্দযুক্ত একটি প্রম্পটের মাধ্যমে স্ক্র্যাচে লেখা যায় কবিতা। রয়েছে থ্রিডি প্রিন্টের চোখ, নতুন হলোগ্রাম, গবেষণাগারে তৈরি খাবার এবং মস্তিষ্কের গতিবিধি পড়তে পারা রোবট। নতুন এই প্রযুক্তি ও আবিষ্কার আমাদের ভবিষ্যৎকে হয়তো চিরতরেই বদলে দেবে।
নেক্রোবোটিকস
ভবিষ্যতের নতুন এই প্রযুক্তিগুলো কখনো কখনো চিন্তারও অতীত উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম। এক্ষেত্রে নেক্রোবোটিকসের ধারণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যে কোনো মৃত জিনিসকে রোবটে পরিণত করার সঙ্গে এই ধারণা জড়িত। অবিশ্বাস্য শোনালেও এই ধারণা পুরোপুরি বদলে দিতে পারে আগামীকে। ঠিক ভয়ংকর ভৌতিক কোনো সিনেমার প্লটের মতো শোনালেও বাস্তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেখানে গবেষকদের দল মৃত একটি মাকড়সাকে রোবট সদৃশ গ্রিপারে পরিণত করেছেন। নতুন এই রোবটকে অন্য বস্তুকে তোলার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। আর এই সক্ষমতা অর্জনের জন্য মাকড়সাটিকে ইনজেকশনের মাধ্যমে বাতাস দেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতি বেশ কার্যকরী। কারণ মাকড়সা তার শরীরের হাত-পা প্রসারিত করার জন্য রক্তের (হেমোলিম্ফ) সংস্করণ বাড়াতে হাইড্রলিক্স ব্যবহার করে। মৃত জিনিসকে রোবটে পরিণত করার এই ধারণা বর্তমানে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এই ধারণা বাস্তবে পরিণত হলে তা আমাদের এমন এক ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে, যেখানে বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নেওয়ার কাজে মৃত সব প্রাণীকে ব্যবহার করা হয়… এর পুরোটাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো মনে হচ্ছে, নাহ!
বালির ব্যাটারি
ভবিষ্যৎকে উন্নত করার প্রতিটি প্রযুক্তিই যে জটিল হবে এমন নয়। এর মধ্যে সহজ ও অত্যন্ত কার্যকর কিছু প্রযুক্তিও রয়েছে। এ ধরনের প্রযুক্তির মধ্য থেকে কিছু ফিনিশ প্রকৌশলী এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন, যাতে বালিকে একটি বিশাল ব্যাটারিতে পরিণত করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন তারা। এই প্রকৌশলীরা ৪ বাই ৭ মিটার স্টিলের একটি কন্টেইনারে ১০০ টন বালি স্তূপ করেন। এরপর বাতাস ও সৌরশক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বিশাল এই বালিরাশিকে উত্তপ্ত করা হয়। যাতে এই তাপকে স্থানীয় কোনো জ্বালানি কোম্পানির মাধ্যমে কাছাকাছি এলাকার সব ভবনকে উষ্ণ করার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতেই দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বালানি সংরক্ষণ করা যায়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রতিরোধক তাপ হিসেবে পরিচিত ধারণার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যেখানে বৈদ্যুতিক প্রবাহের ঘর্ষণের মাধ্যমে কোনো উপাদানকে উত্তপ্ত করা হয়। বালু ছাড়াও অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাটিং নয় এমন কিছু পরিবাহী রয়েছে যা বিদ্যুৎপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে না। বালুর মাধ্যমে
কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই তাপকে পরিবাহীগুলোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুতে প্রবাহিত করে তপ্ত বা গরম করা হয়। যা পরবর্তী সময়ে জ¦ালানি বিদ্যুৎ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ই-স্কিন
কৃত্রিম এক চামড়া, যাকে বলা হচ্ছে ই-স্কিন। এ চামড়ার সহায়তায় মুখোমুখি না থেকেও হাজারো মাইল দূরে থাকা আপনজন বা বন্ধু-বান্ধবকে করা যাবে আলিঙ্গন। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমরা থাকি না কেন, প্রযুক্তির সহায়তায় একে অপরকে দেখা বা মৌখিকভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। তবে দীর্ঘ দূরত্বে থেকেও একে অপরকে স্পর্শের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি বিশ্বে। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাসী বহু দূরে থেকেও স্পর্শের সেই কাক্সিক্ষত অনুভূতি পাবে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। এ অসম্ভবকে সম্ভব করতেই রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন হংকংয়ের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ইঞ্জিনিয়ার। তাদের হাতে তৈরি ওয়্যারলেসভিত্তিক এক ধরনের নরম ই-স্কিন বহু দূরে থাকা দুই প্রান্তের দুই আপনজনকে একদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে আলিঙ্গন করার স্বাদ এনে দেবে।
মহাকাশে স্যাটেলাইট ক্যাটাপ্লট
কে ভেবেছিল যে, একটি মাত্র অস্থায়ী ক্যাটাপ্লটের মাধ্যমেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়ে একদিন মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো সম্ভব হবে। যদিও ক্যাটাপ্লটের চেয়েও অনেক বেশি স্মার্ট ধরনের প্রযুক্তি এরই মধ্যে আবিষ্কার হয়েছে। আর এই প্রযুক্তিটি হলো স্পিনলঞ্চ। এটি এমন একটি প্রটোটাইপ সিস্টেম যা স্যাটেলাইট বা অন্য ধরনের পেলোডকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে এটি প্রচলিত রকেটে পাওয়া রাসায়নিক জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে স্বাভাবিক কৌশলের গতিশক্তি ব্যবহার করে থাকে। স্পিনলঞ্চ ঘণ্টায় ৮ হাজার এবং গতিতে ১০ হাজার পেলোড স্পিন করতে সক্ষম। যদিও মহাকাশের কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য পেলোডের ছোট রকেট ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি, তবে স্পিনলঞ্চের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কল্যাণে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ জ্বালানি ও অবকাঠামো হ্রাস করেছে এই সিস্টেম। এরই মধ্যে স্পিনলঞ্চ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। তবে সিস্টেমটি এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন
কোনো মানবদেহে শূকরের হৃদয় প্রতিস্থাপনের ধারণাটি খুব প্রীতিকর না শোনালেও এটিই সবশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি যা দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের এ পদ্ধতিকেই বলা হয় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন। এ পদ্ধতিতে একটি প্রাণীর শরীর থেকে কোষ, টিস্যু বা একাধিক অঙ্গ এনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে প্রতিস্থাপন বা জুড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাকে সচল করা হয়। এ পদ্ধতিটিই অস্ত্রোপচারের জগতে ঘটাতে পারে বিপ্লব।
এই ধরনের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত হওয়া সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি হলো একজন মানুষের শরীরে একটি শূকরের হৃদপি- ঢুকানো। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের এই অস্ত্রোপচার এ পর্যন্ত দুবার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে একজন রোগী মাত্র কয়েক মাস বেঁচে ছিলেন এবং দ্বিতীয় রোগী এখনো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন অস্ত্রোপচারগুলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রাণীর হৃদপি-কে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের শরীরের মধ্যে রাখা যায় না। এজন্য প্রথমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে একাধিক জিন পরিবর্তন (জিন-এডিটিং) করা প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে কিছু জিনকে হৃদপিন্ড থেকে বের করে আনতে হবে। এরপর প্রতিরোধ সক্ষমতা অনুযায়ী, প্রধানত জীনের চারপাশে থাকা হৃদপিন্ডের টিস্যুও অত্যধিক বৃদ্ধি রোধ করতে ওই জিনের সঙ্গে মানুষের শরীরের জিনোমগুলোকে যুক্ত করতে হবে।
বর্তমান বাস্তবতায় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন সংক্রান্ত অস্ত্রোপচার ঝুঁকিপূর্ণ এবং দ্রুত সাফল্যেরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে বাস্তবতা যাই হোক না কেন, অদূর ভবিষ্যতে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের মতো অস্ত্রোপচার নিয়মিতভাবেই হতে দেখব আমরা। আর এ জন্য প্রাণীর দেহ থেকে টিস্যু বা হৃদপিন্ড নিয়ে মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হবে।
এআই ছবির প্রজন্ম
মানুষের পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কাজ করা এখন নতুন এক বাস্তবতা। এ তালিকায় যুক্ত হতে নতুন যে শিল্পের বিকাশ ঘটেছে- সেটি হলো ছবির জগৎ। ওপেন এআই কোম্পানির গবেষকরা মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে এমন একটি মেশিন বা সফ্টওয়্যার প্রোগাম তৈরি করেছেন, যা শুধুমাত্র শব্দযুক্ত প্রম্পট বা বর্ণনার ভিত্তিতে ইমেজ বা ছবি তৈরি করতে সক্ষম।
‘কাউবয় হ্যাটপরা একটি কুকুর বৃষ্টিতে গান গাইছে- এমন একটি বর্ণনা টাইপ করার সঙ্গে সঙ্গেই এর সঙ্গে মানানসই সম্পূর্ণ আসল চিত্র পাওয়া যাবে। এমনকি আপনি চাইলে, কোন শিল্পের শৈলী ব্যবহার করা হবে তার অনুরোধও ওই বর্ণনায় তুলে ধরতে পারেন।
তবে কৃত্রিম এই ছবি আঁকার প্রযুক্তিটি কিন্তু একেবারেই নিখুঁত নয়। এছাড়াও এতে রয়েছে আরও নানা সমস্যা। যেমন- কার্টুন চরিত্রগুলো নকশা করার ক্ষেত্রে দুর্বল প্রম্পট দেওয়া হয়েছিল এআইয়ে।
ডাল-ই নামে পরিচিত এই প্রযুক্তিটি এখন এর উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে এবং এই উন্নয়ন পরিকল্পনার পেছনে কাজ করা দলটি এটিকে আরও উন্নত করতে কাজ করে চলেছে।
ভবিষ্যতে আমরা এমনটাও দেখতে পাব যে, এই এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছবির প্রদর্শনী আয়োজন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দ্রুত আসল ছবি পাওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোকে ইন্টারনেটে আমরা যেভাবে মেমেজ তৈরি করি, তাতে অবশ্যই বিপ্লব ঘটাতে হবে। এরই সঙ্গে মিডজার্নি নামে পরিচিত আরেকটি এআই ইমেজ জেনারেটর প্রযুক্তিও রয়েছে, যা সাধারণ বর্ণনার প্রম্পটসহ গথিক মাস্টারপিস তৈরি করে। এর মানে, আমরা সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যতে বসবাস শুরু করে ফেলেছি।