নগরবাসীর জন্য বাসার ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাবার পানি সরবরাহ করার পদ্ধতি নিয়ে ব্যবসায়িক আইডিয়া দিয়ে এ বছরের ওমেন ইন টেক সম্মাননা জিতে নিলো টিম এমপাওয়ার। প্রথম রানার্সআপ হয়েছে তেরা বিন এবং দ্বিতীয় রানার্সআপ সোলনেট।
প্রতিযোগিতায় ‘ধারা’ প্রকল্প দিয়ে আইইউটি-বিটিএম এর ছাত্রী মাহমুদা নাঈমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এই চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যরা হলেন পুষ্পিতা খান (আইইউটি-ট্রিপল ই), প্রিমা সরকার (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, সিএসই), বুশরা হাসান (ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ট্রিপল ই) এবং লাবিবা তারিক (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রিপল ই)।
প্রকল্প বিষয়ে দলের সদস্য পুষ্পিতা খান জানান, যদি কোন চারতলা বাসার ছাদের উপরে সোলার প্যানেল বসানো হয় এবং এই প্রজেক্ট চালু করা হয় সে ক্ষেত্রে শুরুতে ২ লাখ টাকা খরচ পড়বে। এছাড়া ওই বাসায় যদি চারটি ইউনিট থাকে, তাহলে প্রতিটি ইউনিট থেকে ৪০০ টাকা করে সার্ভিস চার্জ আদায় করা হবে। এর মাধ্যমে নিরাপদ ও স্বাস্থ্য ও সুরক্ষিত খাবার পানি ঢাকা শহরে সরবরাহ করা যাবে। এই প্রকল্পটি শহর ও শহরতলীর নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের জন্য পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির একটি সাশ্রয়ী সমাধান।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড ফিনালে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজ যারা বিজয়ী হননি তারা হয়তো কিছুটা ভারাক্রান্ত। তবে আমি সকল অংশগ্রহণকারীদের জন্যও স্টার্টআপ হিসেবে ইনোভেশন গ্র্যান্ট পেতে পারেন। ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড অন্টারপ্রেনিউরশিপ একাডেমির কাছে আইডিয়াগুলো উপস্থাপন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নতুন রূপকল্প অনুযায়ী, প্রবলেম সলভিং প্রজন্ম গড়ে তুলেতে আমাদের সরকারকে ফেসলেস, দুর্নীতিমুক্ত অটোমেটেড, ইন্টার অপারেবল, পেপারলেস করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের সেই স্মার্ট সমাজে অর্ধেক নারীর অংশ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
পলক আরো বলেন, আমরা আশা করবো আগামী বছর হুয়াওয়ে বাংলাদেশে তাদের ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ তৈরি করবে। একইসঙ্গে আরো খুশি হবো যেনো হুয়াওয়ে বাংলাদেশে একটি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র উপস্থাপন করে যেখানে আমাদের নারী প্রকৌশলীরা বিশেষ অবদান রাখবে। একই ভাবে আগামী ১৭ বছর এখনকার মতোই চীন সরকার বাংলাদেশের স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে এবং পাশে থাকবে।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ, সংসদ সদস্য জারা জাবিন মাহবুব, ইউনেস্কো বাংলাদেশের রিপ্রেজেন্টেটিভ সুজন ভাইস, আইইউটি-এর ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং হুয়াওয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সিইও প্যান জুন ফেং অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূত জনাব ইয়াও ওয়েন বলেন, “ডিজিটাল ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীদের উন্নয়ন এবং চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে দৃঢ় করার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য আমি হুয়াওয়েকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আজকের প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের আইসিটি সেক্টরে নারীরা কতোটা সম্ভাবনার অধিকারী।”
পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য জারা জাবীন মাহবুব, এমপি, বলেন. “হুয়াওয়ের ‘ওমেন ইন টেক’-এর মতো প্রোগ্রামগুলো আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি বর্তমান প্রজন্মের প্রতিভাবান নারী শিক্ষার্থীদেরকে তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে এবং ভবিষ্যতে যোগ্য পেশাজীবী হওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে উত্সাহিত করে। আমি বিশেষভাবে আনন্দিত এটি দেখে যে, এই প্রতিযোগিতায় ৭৫০ জনেরও বেশি নারী শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। এই প্রথম আসরের সাফল্য নিঃসন্দেহে আগামী বছরগুলিতে আরও বেশি নারী শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করবে।”
বিটিআরসি-এর চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বর্তমান সরকারের দুইটি প্রধান এজেন্ডা হলো ডিজিটাল অগ্রগতি এবং নারীর ক্ষমতায়ন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিগত বছরগুলোতে উভয় ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছি। আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে আইসিটি সেক্টরে ২৫ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাই। হুয়াওয়ের ‘ওমেন ইন টেক’-এর মতো একটি প্রোগ্রাম বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এর সাথে উদ্যোগটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।”
বাংলাদেশে ইউনেস্কোর অফিস প্রধান ও প্রতিনিধি ড. সুজান ভাইজ বলেন, “এই বছরের উইমেন ইন টেক-এ অংশগ্রহণকারী তরুণীরা দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রযুক্তিশিল্পে তাঁদের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে, যা স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণেও কাজ করবে। এই ধরনের প্রোগ্রাম আইসিটি খাতে নারীদের ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেয়ার সম্ভাবনাকে আরও বলিষ্ঠ করার পাশাপাশি নতুনদের জন্য একটি আদর্শ তৈরি করে। নারীদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হুয়াওয়ের যে প্রতিশ্রুতি, সে কারণেই এই ধরনের চমৎকার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।”
আইইউটি-এর ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “নারী ক্ষমতায়নের একটি প্রতিফলনই হচ্ছে এই প্রোগ্রাম। এই প্রতিযোগিতা এমন একটি ভবিষ্যৎ তৈরিতে সাহায্য করবে, যেখানে নারীরা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বিকাশে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি এই ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি সকল বিজয়ীকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।”
হুয়াওয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও হুয়াওয়ে বাংলাদেশের সিইও প্যান জুনফেং বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৬ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ২৫%-এ উন্নীত করার উপর জোর দিয়েছেন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এই খাতে ৫০% নারী পেশাজীবীর অংশগ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বাংলাদেশে নারীদের প্রতিভা ও দক্ষতা বিকাশ, ইন্টার্নশিপ ও চাকরির উপর গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রতিভা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীরা যাতে পেশাক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যায়, সে বিষয়টিকে আমরা বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমাদের ‘উইমেন ইন টেক’ প্রতিযোগিতায় নারী শিক্ষার্থী এবং কর্মীদের জ্ঞান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়িক এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরা নারীদের আইসিটি মেধার বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।”
হুয়াওয়ের কৌশলগত সহযোগী হিসেবে প্রথম বারের মতো ‘টেক ফর হার, টেক বাই হার, টেক উইথ হার’ প্রতিপাদ্যে এই প্রতিযোগিতার সহযোগী ছিলো ইউনেস্ক বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতায় ৭৫০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্য থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৮ জনকে বাছাই করা হয়। এই পর্যায়ে একক ও দলীয় – দুই রকম প্রতিযোগিতা ছিল। আইসিটি-কে কাজে লাগিয়ে কীভাবে নতুন সমাধান সম্ভব এবং এর ব্যবসায়িক সফলতার সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে দলভিত্তিক আইডিয়াগুলোকে নির্বাচিত করা হয়। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দল ছাড়া প্রথম রানার আপ হিসেবে বিজয়ী হয়েছে ‘তেরা বিন’ এর বিজনেস আইডিয়া ছিল সোলার কম্পোষ্টার ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা যায়। দ্বিতীয় রানার আপ হিসেবে নির্বাচিত ‘সোলনেট’ দলটি ক্লাউড প্রযুক্তি ও অ্যাপের ব্যবহার করে কীভাবে সহজে ও কম খরচে সোলার প্ল্যান্ট তৈরি ও ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে কাজ করেছে।
চ্যাম্পিয়ন, ১ম ও ২য় রানার আপ দল যথাক্রমে তিন লাখ টাকা, দুই লাখ টাকা এবং এক লাখ টাকা মূল্যের প্রাইজমানি পেয়েছে। এই অর্থ তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে পারবে।
এছাড়া চারজন প্রতিযোগী তাঁদের বিশেষ পারফরমেন্সের কারণে ব্যক্তিগতভাবে বিজয়ী হয়েছেন। বিজয়ীরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের ছাত্রী কায়সারী ফেরদৌস, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির গ্রাজুয়েট মাহমুদা নাঈম, এসবিআইটি লিমিটেডের ডিজাইন ভেরিফিকেশন ইঞ্জিনিয়ার সুমাইয়া তারিক লাবিবা এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির ইইই বিভাগের ছাত্রী সাফরিনা কবির। এই বিজয়ীরা চীনে সফর করে দেশটির স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেম সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার সুযোগ পাবেন।