সাইবার নিরাপত্তা গবেষকরা সম্প্রতি জানিয়েছে যে, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস সম্পর্কিত তথ্য হেরফের (জিপিএস স্পুফিং) করার মাধ্যমে এখন ‘সময় হ্যাক’ বা সময় সম্পর্কিত ভুল তথ্য প্রদান করা হচ্ছে। অর্থাৎ জিপিএস স্পুফিং-এ নতুন সংযোজন হচ্ছে এই টাইম বা সময় হ্যাক করার বিষয়টি।
সাম্প্রতিক সময়ে জিপিএস স্পুফিং বা জিপিএস হামলার ঘটনা ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যিক এয়ারলাইনগুলোতা। এমনটাই জানিয়েছে বিমান চলাচল সম্পর্কিত উপদেষ্টা সংস্থা অপস্গ্রুপ।
জিপিএস স্পুফিং কি?
জিপিএস স্পুফিং হচ্ছে এক ধরণের ডিজিটাল বা সাইবার হামলা যার মাধ্যমে জিপিএস ডেটাকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ভুলভাবে উপস্থাপন (ম্যানিপুলেট) করা হয়। অর্থাৎ, জিপিএস স্পুফিং এর কারণে জিপিএস রিসিভার অবস্থান (লোকেশন) সম্পর্কিত তথ্য ভুল ক্যালকুলেট করে থাকে- আর এটাই জিপিএস-কে স্পুফ করার মূল উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, নির্বিঘ্নে বিমান চলাচল নিশ্চিত করার জন্য জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
জিপিএস স্পুফিং-এর সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে এগুলোর অনেকগুলোই ঘটেছে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের আশেপাশে। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যেই হচ্ছে আশেপাশের আকাশসীমায় লোকেশন সম্পর্কিত ভুল তথ্য প্রচার করা করা, যাতে করে আসন্ন ড্রোন বা মিসাইলকে বিভ্রান্ত করা যায়।
গত শনিবার (১১ আগস্ট) আমেরিকার লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত হয় ডেফ কন হ্যাকিং সম্মেলন। উক্ত সম্মেলনা ব্রিটিশ সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পেন টেস্ট পার্টনার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা কেন মুনরো বলেন, “আমরা জিপিএস-কে অবস্থান (লোকেশনের) সম্পর্কিত ডেটার উৎস হিসেবেই বেশি দেখে থাকি, কিন্তু বাস্তবে এটা হচ্ছে সময় সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের উৎস।” তিনি আরও বলেন, স্পুফিং-এর সময় আমরা উড়োজাহাজের ঘড়িগুলো থেকে অস্বাভাবিক রিপোর্ট পেতে শুরু করি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মুনরো সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে একটি উড়োজাহাজের অন-বোর্ড ঘড়িতে হঠাৎ করে সময় কয়েক বছর সামনে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোন এক বছরের সময় দেখাতে শুরু করে ঘড়ি। এর ফলে ডিজিটালি এনক্রিপ্ট করা কমিউনিকেশন সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে উড়োজাহাজটির।
এরপর বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় নিয়ে প্রকৌশলীরা উড়োজাহাজটির অনবোর্ড সিস্টেমকে ম্যানুয়ালি রিসেট করে। তবে মুনরো উক্ত এয়ারলাইন বা এয়ারক্রাফটের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
গত এপ্রিলে ফিনএয়ার সাময়িকভাবে উত্তর এস্তোনিয়ার শহর ত্রাতু-তে নিজেদের ফ্লাইট বন্ধ রাখে। কারণ হিসেবে তারা জিপিএস স্পুফিং-এর কথা উল্লেখ করে।
জিপিএস প্রযুক্তির আগে এয়ারলাইনগুলো গ্রাউন্ড ডিভাইস ব্যবহার করে রেডিও বিম প্রেরণের মাধ্যমে উড়োজাহাজকে মাটিতে অবতরণে সহায়তা করতো। এখন সেই ব্যয়বহুল গ্রাউন্ড ডিভাইসের জায়গা নিয়েছে জিপিএস। কিন্তু এটাও সত্য যে জিপিএস সিগন্যালকে ব্যহত করা বা ব্লক করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ এবং এটা করার জন্য প্রয়োজনীয় টুলসও বেশ সস্তা ও সহজলভ্য। পাশাপাশি এই টুলসগুলো চালনার জন্য সামান্য প্রযুক্তিগত জ্ঞানই যথেষ্ট।
তবে জিপিএস স্পুফিং-এর কারণে উড়োজাহাজ ক্র্যাশ হবার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও এগুলো ছোট ছোট সমস্যা চক্রের সূত্রপাত ঘটায়- যেখান থেকে গুরুতর কিছু ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায় বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন মুনরো।
প্রজুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে জিপিএস-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনকে আরও অনেক সহজ করেছে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাকে সাধারণের হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছে। অনেক বেশি সহজলভ্য করে তুলেছে প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহার। কিন্তু প্রযুক্তির এই আশীর্বাদ বিভীষিকায় পরিণত হবার অনেক উদাহরণও আমাদের চারপাশেই আছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কতটা আন্তরিক সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।