দেশে বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথেও আসছে মোবাইল ফোন। সেই ফোনের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দেশে বিক্রি হওয়া মোট মোবাইলের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অবৈধ পথে দেশে আসা মোবাইলের এই বাজারকে বলা হয় গ্রে মার্কেট। কিছুদিন আগেও যা খুব একটা বড় ছিল না। সম্প্রতি আবার বাড়তে শুরু করেছে গ্রে মার্কেটের পরিসর। মোবাইল বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল ফোনের রেজিস্ট্রেশনের সময় দেশে অবৈধ পথে মোবাইল ফোন আসার পরিমাণ কমে গিয়েছিল। হ্যান্ডসেটের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবারও বাড়তে শুরু করে। এখনও মোবাইল ফোনের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে, তবে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে। যেকোনও (বৈধ ও অবৈধ) ফোন চালু করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সেটসহ আইএমইআই ডাটাবেজে (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ফোন ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) নিবন্ধিত হয়ে যাচ্ছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং বিটিআরসি এনইআইআর নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিটিআরসিতে এক মতবিনিময় সভায় পলক জানান, ছয় মাসের মধ্যে অবৈধ হ্যান্ডসেট বন্ধ করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে বিটিআরসি আবারও গ্রাহককে বৈধতা যাচাই করে হ্যান্ডসেট কেনার অনুরোধ করে। এনইআইআর প্রকল্প পুরোপুরি কার্যকর করতে আগামী জুলাই পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানিয়েছিল কমিশন। কিন্তু এখন সেই সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে যাচ্ছে বিটিআরসি।
দেশে মোবাইল ফোনের উৎপাদন কমছেই। সর্বশেষ তিন মাসে দেশে সাড়ে পাঁচ লাখ মোবাইল ফোনের উৎপাদন কম হয়েছে। এর মধ্যে বেশি কমেছে স্মার্টফোনের উৎপাদন। একই সময়ে বিদেশ থেকে মোবাইল ফোনের আমদানিও নিম্নমুখী। অথচ দেশের মানুষের হাতে মোবাইল ফোন বাড়ছে। বিশেষ করে হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে স্মার্টফোন।
দেশে উৎপাদন কম, আমদানিও কম। তাহলে ছড়িয়েপড়া এসব স্মার্টফোন দেশে আসছে কীভাবে—এমন প্রশ্ন তুলেছেন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা।
দেশে মোবাইল ফোনের উৎপাদন ও আমদানি নিয়ে প্রতি মাসে তথ্য প্রকাশ করে থাকে বিটিআরসি। সর্বশেষ গত ৩ মার্চ জানুয়ারি মাসের তথ্য প্রকাশ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। বিটিআরসির প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৩২ হাজার। ডিসেম্বরে উৎপাদন হয়েছিল ২১ লাখ ১০ হাজার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেই সংখ্যা নেমেছে ১৮ লাখ ৯২ হাজারে। অর্থাৎ তিন মাসে ৫ লাখ ৪০ হাজার মোবাইল ফোন উৎপাদন কমেছে।
সর্বশেষ তিন মাসে স্মার্টফোনের উৎপাদন বেশি কমেছে। গত নভেম্বরে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছিল স্মার্টফোন। জানুয়ারিতে সেই অনুপাত কমে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে ফিচার ফোন (টু-জি) উৎপাদন বেড়েছে। নভেম্বরে ফিচার ফোনের উৎপাদনের হার ছিল ৭১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ২০ শতাংশ।
অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা মোবাইল ফোনের সবই স্মার্টফোন। বিটিআরসির প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী—২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ৯টি ফোর-জি এবং ১০ হাজার ফাইভ-জি স্মার্টফোন আমদানি করা হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা আরও কমেছে। ওই মাসে মাত্র পাঁচ হাজার ৫০টি ফাইভ-জি মোবাইল ফোন আমদানি করা হয়েছে।
অবশ্য ফেব্রুয়ারি ও মার্চের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি বিটিআরসি। তবে দেশে উৎপাদন ও আমদানির যে তথ্য বিটিআরসি প্রকাশ করে থাকে, এর বাইরে যত মোবাইল ফোন দেশে আসছে, তা অবৈধ বা অনিবন্ধিত।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে বড় হচ্ছে গ্রে মার্কেট। সরকার হ্যান্ডসেটের রেজিস্ট্রেশন চালুর পর এই বাজার ১০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। এখন তো আগের অবস্থানকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশে বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মোবাইল ফোন বিক্রি হয়। বৈধপথে আসা এবং দেশে উৎপাদিত মোবাইলের সঙ্গে এই সংখ্যা যোগ করলে তা আরও বেশি হতো ।
(২৭ মার্চ) ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমআইওবির সভাপতি ও এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজের জাকারিয়া শাহিদ জানান, দেশে মোবাইল ফোনের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। এ শিল্পে সরাসরি তিন থেকে চার লাখ মানুষ জড়িত। ২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে শতভাগ মোবাইল ফোন বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু সরকারি প্রণোদনায় ২০১৮ সাল থেকে দেশে একের পর এক মোবাইল কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ১৭টি মোবাইল ফোন কারখানা দেশে স্থাপিত হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের চাহিদার প্রায় ৯৯ শতাংশ ফোনই এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু অবৈধভাবে ফোন আমদানি বন্ধ না করায় স্থানীয় বাজারের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ এখন চোরাই ফোনের দখলে। তৈরি ফোন আমদানিতে যেখানে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর রয়েছে, সেখানে এসব ফোন বিনা শুল্কে বাজারজাত হচ্ছে। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে কারখানা স্থাপন করা ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরও বলেন, ১৭টি কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এসব কারখানায় দক্ষ শ্রমিক ২৫ হাজারের বেশি। পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে আরও প্রায় ৫০ হাজার লোকের। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার। আরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ মোবাইল ফোন রপ্তানির।
দেশের মার্কেটগুলোতে বৈধ পথে আসা এবং অবৈধ পথে আসা দুইই পাওয়া যায়। দাম কম হওয়ায় অনেক ক্রেতাই অবৈধ পথে আসা কিনতে আগ্রহী হন। যখন এসব ফোনে সমস্যা হয় তখন আসলে কেউই এই ফোনের দায়িত্ব নিতে চান না এবং এইসব ফোনের পার্টস এ্যাভেইএ্যাবল না থাকার কারনে সমস্যার পড়তে হয় গ্রাহককে। অবৈধ পথে আসা পণ্য যারা বিক্রি করেন তারাও মাঝে মাঝে ওয়ারেন্টি দেন। বিক্রেতারা বলেন, বৈধ পণ্যে অনেক সুযোগ- সুবিধা পান ক্রেতারা। অবৈধ পথে আসা পান কম দামে। এ কারণে দিনে দিনে আবার অবৈধ পথে আসা পণ্য কেনার হার বাড়ছে। বাজারটা বড় হতে হতে এখন ৩৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এতে কমছে এ খাতের রাজস্ব। কারণ অবৈধ পথে আসা পণ্যে সরকার কোনও রাজস্ব পায় না।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে বড় হচ্ছে গ্রে মার্কেট। সরকার হ্যান্ডসেটের রেজিস্ট্রেশন চালুর পর এই বাজার ১০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। এখন তো আগের অবস্থানকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশে বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মোবাইল ফোন বিক্রি হয়। বৈধপথে আসা এবং দেশে উৎপাদিত মোবাইলের সঙ্গে এই সংখ্যা যোগ করলে তা আরও বেশি হতো।