তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে এক মূর্তমান আতংকের নাম মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। কামরুজ্জামান যার প্রতি নাখোশ হয়েছেন, তাকেই পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের ভয় দেখিয়ে আইসিটি বিভাগে তৈরি ত্রাসের রাজত্বের মুকুটবিহীন সম্রাট বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ট্রান্সমিশন) এই কামরুজ্জামান। অন্তত আধা ডজন প্রমাণিত অভিযোগে প্রকল্প থেকে চাকরিচ্যুত কামরুজ্জামান ডাটা সেন্টারে ফিরতে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন খোদ সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককেও। প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ প্রক্রিয়া, সহকর্মীদের সাথে অসদাচরণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিরোধীপক্ষের সামিয়ানায় সরব উপস্থিতির মতো অভিযোগ এবং নানান অনিয়মের পরেও ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন কামরুজ্জামান।
২০১৬ সালের মে’তে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীনে সেসময় চলমান ‘ফোর টিয়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন’ প্রকল্পে মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার (কম্পিউটার ও নেটওয়ার্ক) পদে নিয়োগ পান কামরুজ্জামান। এই পদে লিখিত পরীক্ষায় সর্বনিম্ন ৪৪ নম্বর পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে ছিলেন তিনি। অভিযোগ আছে, সর্বোচ্চ ৬৪ নম্বরধারী এ এস এম নাজমুল হককে মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতে দেয়নি কামরুজ্জামানের ক্যাডার বাহিনী। আশ্চর্যজনকভাবে মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ১৮ নম্বর পেয়ে চূড়ান্তভাবে শীর্ষে চলে আসেন কামরুজ্জামান। অনুসন্ধানে সেসময়কার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় ৫৩ এবং ৫১ নম্বর পাওয়া যথাক্রমে ইশতিয়াক আজাদ এবং আকতারুজ্জামান মৌখিক পরীক্ষায় পান যথাক্রমে ৮ এবং ১০। আইসিটি বিভাগের একটি সূত্রের মতে, সেসময়কার প্রকল্প পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহর সরাসরি হস্তক্ষেপে লিখিত পরীক্ষায় সর্বনিম্ন নম্বর পাওয়া কামরুজ্জামানকে মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ তথা ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তার চাকরির মেয়াদ থাকার কথা ছিল।
অবশ্য চাকরি পেয়ে আরও ঔদ্ধত হন কামরুজ্জামান। প্রকল্পের জনবল স্থায়ীকরণের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থেকে ‘ফান্ড কালেকশন’ প্রস্তাব দেন। এমন আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণে পূর্বেও তাকে প্রকল্প অফিস থেকে বদলি করা হয়েছিল। বিভিন্ন সময় বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতেন বেপরোয়া কামরুজ্জামান। তার সুদৃষ্টি অথবা কুদৃষ্টি যে সহকর্মীর উপর পড়েছে, তার জীবনই হয়েছে অতিষ্ঠ। এক নারী সহকর্মীকে এসএমএস এবং মেসেঞ্জারে অশালীন ও অপেশাদার ভাষায় হেনস্তা করেছেন তিনি। বদলিকৃত কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে হুমকি দেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইরেশ সারোয়ারকে। ইরেশ সহ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রকল্প পরিচালক বরাবর অভিযোগ এবং থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন মালির মতো নিম্নশ্রেণীর এক কর্মচারীকেও। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের কিছু মালামাল কৌশলে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এমন অন্তত ছয়টি ভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৯ সালের মার্চে চাকরিচ্যুত হন কামরুজ্জামান। তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার চাকরি নামক সেই সোনার হরিণ ফিরে পেতে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
এরপর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সহ চাকরিতে পুনঃবহালের জন্য তিন দফা আবেদন করেন কামরুজ্জামান। ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কামরুজ্জামানকে চাকরিতে পুনঃবহালের তদবির করে আইসিটি বিভাগের তৎকালীন সচিব বরাবর সরকারি চিঠি দেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব (প্রশাসন-১) নূর-ই-খাজা আলামীন সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিসিসি’র তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক পার্থপ্রতিম দেব নিজ পর্যালোচনায় কামরুজ্জামানকে পুনঃবহাল করা সমিচীন হবে না বলে মত দেন। তবে প্রকল্প থেকে বিডিসিসিএল গঠিত হলে পুরনো হাতিয়ার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন করে ব্যবহার করেন তিনি। সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেন, প্রতিমন্ত্রী তার চাকরির পক্ষে ছিলেন না। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের দুই প্রভাবশালী নেতাকে দিয়ে চাপ দেওয়ান পলককে। তাতেও রাজি না হলে পলককে নাটোরে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করে কামরুজ্জামান গং। পরে একরকম বাধ্য হয়ে কামরুজ্জামানকে চাকরির ব্যবস্থা নিতে বলেন পলক। জানা যায়, পলকের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ট্রান্সমিশন) পদে আবেদন করে নিয়োগ পরীক্ষা দেন কামরুজ্জামান। তবে বুয়েটের অধীন অনুষ্ঠিত সেই পরীক্ষায় অকৃতকার্য তিনি। কামরুজ্জামানকে চাকরি দিতে কারিগরি পদ হলেও পরীক্ষা কেন্দ্র বদলে বিসিসি’র অধীনে পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয় কামরুজ্জামানের। এবার কামরুজ্জামানকে কৃতকার্য দেখানো হয়। আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মেহেদি এবং বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান খান এই নিয়োগ কমিটির যথাক্রমে আহবায়ক এবং সদস্য সচিব ছিলেন। কমিটির একটি সূত্র কামরুজ্জামানের কৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি যাচাইয়ে বিসিসি’র কাছে তার লিখতি পরীক্ষার খাতা চাইলেও সেটি দেওয়া হয়নি।
শেষমেশ ২০২৩ সালের জুনে বিডিসিসিএলে চাকরি পান কামরুজ্জামান। এবার হয়ে ওঠেন পূর্বের থেকেও ভয়াবহ। মুক্তিযোদ্ধা বাবার চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হুমকিতে আইসিটি বিভাগের সহকর্মীদের তটস্থ রাখতেন কামরুজ্জামান। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হোয়াটস অ্যাপে বা মেসেঞ্জারে অপেশাদার মেসেজ দিতেন তিনি। বাবার কারণে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক চাকরি দিয়েছেন বলে প্রকাশ্যেই বলতেন কামরুজ্জামান।
গত মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও বিতর্কিত ভূমিকা ছিল কামরুজ্জামানের। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সক্রিয় সদস্য হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার ফেসবুক প্রোফাইলে আন্দোলনের বিপক্ষে বিভিন্ন সময় পোস্ট করেছিলেন বলে একাধিক ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন। তবে সরকার পতনের পর সেগুলো মুছে ফেলে নিজেকে এখন বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা হিসেবে দাবি করছেন। গত ২২ আগস্ট বিসিসি এবং বিডিসিসিএল এর ৬ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয় আইসিটি বিভাগ। বিভাগের উপ-সচিব জিল্লুর রহমান স্বাক্ষরিত ঐ আদেশে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় এবং অভিযোগ তদন্তাধীন থাকায় এই আদেশ দেওয়া হয়। তবে এই তালিকায় প্রথমে মোট ৭ জন কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথম আদেশের ৬ নম্বরে ছিলেন কামরুজ্জামান। পরবর্তীতে কামরুজ্জামানকে বাদ দিয়ে ৬ জনের বিষয়ে আদেশ জারি করে আইসিটি বিভাগ। তবে ‘ক্ল্যারিকাল এরর’ বা করণিক ত্রুটিতে কামরুজ্জামানের নাম তালিকায় ছিল বলে কাছে দাবি করেছেন জিল্লুর রহমান। যদিও বিডিসিসিএলের একটি সূত্র বলছে, এমডি আতাউর রহমানকে ম্যানেজ করে তালিকা থেকে নিজের নাম সরিয়েছেন কামরুজ্জামান। এমনকি পরিবর্তিত তালিকা সম্বলিত ফাইল ইনিশিয়েটও করেছেন তিনি। গত ২০ আগস্ট বিডিসিসিএলের এমডি আতাউর রহমান জনবল নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আইসিটি বিভাগের সচিব সামসুল আরেফিন বরাবর একটি চিঠি দেন। ঐ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং জিআরএস সিস্টেম সহ ই-মেইলে অভিযোগ পান এমডি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে কামরুজ্জামানের নিয়োগের অনিয়মও উঠে আসে। তবে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার সর্বশেষ আদেশেও অধরাই থাকেন কামরুজ্জামান। তবে তদন্তসাপেক্ষে যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে এবং এটি চলমান প্রক্রিয়া বলে জানান আইসিটি বিভাগের উপসচিব জিল্লুর রহমান।