গুগলের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে বিজ্ঞাপন ব্যবসা। এবার সেই বিজ্ঞাপন ব্যবসাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে মার্কিন সরকার। অভিযোগ, গুগল এই লাভজনক বিজ্ঞাপন প্রযুক্তির ব্যবসায় একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের এক আদালতে এ–সংক্রান্ত বিচার শুরু হবে।
বিবিসি জানায়, ২০২৩ সালে গুগল অনলাইন বিজ্ঞাপন ব্যবসা থেকে ২০০ বিলিয়ন বা ২০ হাজার কোটি ডলার রাজস্ব আয় করেছে। এই খাতের অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে গুগলের আয়ের ব্যবধান যোজন যোজন। সে কারণে অনেক দিন থেকেই গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই অনলাইন বিজ্ঞাপনের জগতে গুগল একচেটিয়া ব্যবসা করছে।
অ্যালফাবেট অবশ্য একচেটিয়া ব্যবসার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা বলেছে, এই ব্যবসায় তাদের কৌশল অত্যন্ত কার্যকর; সে কারণে তাদের এই বাড়বাড়ন্ত। এখানে একচেটিয়াত্বের কিছু নেই। কিন্তু সরকার বলছে, গুগল বাজারে তার প্রভাব খাটিয়ে প্রতিযোগীদের দমিয়ে রাখছে।
জর্জিয়া স্কুল অব লর অধ্যাপক লরা ফিলিপস সোয়্যের বলেন, এই শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ; প্রতিদিন শত শত কোটি মানুষ এই জগতে বিচরণ করে। সে কারণে এই মামলা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় কোম্পানি হিসেবে গুগলের বিরুদ্ধে অ্যান্টি–ট্রাস্ট বা প্রতিযোগিতা ভঙ্গের মামলা হলো। আগস্ট মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের এক বিচারক বলেছেন, অনলাইন সার্চ বা অনুসন্ধানের বাজারে গুগলের প্রভাব অবৈধ।
বিচার বিভাগ ও কোয়ালিশন অব স্টেটসের মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের রাজ্যে গুগলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাজারে তার যে প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, তা দিয়ে গুগল এই বাজারে অন্যদের উঠতে দেয় না বা তাদের টুঁটি চেপে ধরে ও প্রতিযোগিতা রুদ্ধ করে।
কিন্তু গুগল বলছে, এই ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জগতে শত শত কোম্পানি আছে। প্রতিদিন তারা কোটি কোটি গ্রাহকের সামনে এসব বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে, গুগল সেই কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি।
গুগল আরও বলেছে, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জগতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। অর্থাৎ বিজ্ঞাপনদাতারা আরও বেশি ডিজিটালমুখী হচ্ছেন। শুধু গুগল নয়, অন্যান্য কোম্পানি যেমন অ্যাপল, আমাজন ও টিকটকের মতো কোম্পানির বিজ্ঞাপনী রাজস্ব বাড়ছে।
উভয় পক্ষই আজ যুক্তরাষ্ট্রের এক ডিস্ট্রিক্ট আদালতে নিজেদের যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করবে। এর আগে গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের সেই আদালত রুলিংয়ে বলেছেন যে অনলাইন বিজ্ঞাপনের জগতে গুগল একচেটিয়া হয়ে উঠেছে। তারা এখন অন্যান্য কোম্পানির টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করছে। বিচারক আরও বলেন, গুগল এখন একচেটিয়া কোম্পানি হিসেবে কাজ করছে।
গুগল বরাবর যা বলে, গত মাসের রায়ের পরও তাই বলেছে, গুগলের পণ্য অন্যদের চেয়ে ভালো; সে জন্য তাদের বিজ্ঞাপনী রাজস্ব আয় অন্যদের চেয়ে বেশি।
গুগল কি ভেঙে যাবে
গত মাসের সেই রুলিংয়ে আরও বলা হয়, ইন্টারনেটের জগতে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে যা যা করা দরকার, গুগল তার সবই করেছে এবং সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। এরপর কী ঘটে, এখন সেটাই দেখার বিষয়। সেই রুলিং টিকে গেলে মার্কিন সরকার গুগলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে; এমনকি তারা গুগলের মতো কোম্পানিকে ভেঙেও দিতে পারে। সেটা হলে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টি–ট্রাস্ট আইনের অধীনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হবে। ১৯৮০-এর দশকে সে দেশের কিছু টেলিকম কোম্পানি এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে একাধিক তেল কোম্পানি এ আইনের অধীনে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
গুগল ভেঙে দেওয়া হলে বিনিয়োগকারীদের কাছে তা বড় ঘটনাই হবে। অ্যালফাবেট বড় এক কোম্পানি। এই কোম্পানির বাজার মূলধন দুই ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি, আর তার ব্যবসার মূল হাতিয়ার হচ্ছে গুগল। বিশ্বের খুব কম মানুষ ও কোম্পানি আছে, যারা কোনো না কোনোভাবে গুগলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
এই কোম্পানি কীভাবে ভেঙে দেওয়া হবে এবং এরপর তারা মুনাফা ধরে রাখতে পারবে কি না এবং বাজারে তার বড় প্রভাব পড়বে কি না, এসব প্রশ্ন উঠেছে। তার চেয়ে বড় কথা, সারা পৃথিবীতে এখন যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে, তাতে পরিবর্তন আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বিশ্লেষক ড্যান ইভেস বলেন, গুগলের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের বড় বিজয় হতে যাচ্ছে। এই সফলতা ব্যবহার করে সরকার সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেবে বলে মত দেন তিনি। তাঁর মতে, গুগল ভেঙে দেওয়া সমাধান নয়।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক আদালত মনে করে, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের এই খুঁটিনাটি বিষয় খুবই জটিল; সে কারণে বিচার বিভাগের পক্ষে রায় দেওয়া কঠিন হতে পারে। অ্যান্টি–ট্রাস্ট বিষয়ের আইনের শিক্ষক রেবেকা অ্যালেন্সওর্থ বলেন, মানুষ সার্চ ইঞ্জিন বোঝে। কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি অনেক জটিল, এটা সবার বোধগম্য নয়।
প্রযুক্তির জগতে একচেটিয়া
একচেটিয়াতন্ত্রের অভিযোগ কেবল গুগলের বিরুদ্ধে নয়, অন্যান্য বড় কোম্পানির বিরুদ্ধেও আছে। চলতি বছর প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপলের বিরুদ্ধেও স্মার্টফোনের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখা ও বাজার থেকে প্রতিযোগীদের হটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি এই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
গত কয়েক বছরে ইন্টারনেটের জগতে গুগলের প্রাধান্য অবশ্য কিছুটা খর্ব হয়েছে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইভিত্তিক চ্যাটজিপিটি আসার পর গুগলের প্রাধান্য কিছুটা কমেছে। এই প্রতিযোগিতায় গুগল কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে বিজ্ঞাপনের ব্যবসা দিয়ে সেই ক্ষতি তারা কাটাতে পারছে।
কিন্তু গত মাসে আদালতের রুলিংয়ের পর গুগল সম্ভবত তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। এরপর আজ থেকে শুরু হওয়া বিচারে কী রায় হয়, মানুষ সেদিকে তাকিয়ে থাকবে।