সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ডিজিটাল রূপে তুলে ধরতে গচ্ছা গিয়েছে ৩৪ কোটি টাকারও বেশি। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অতি আদিখ্যেতায় ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্র ও জনগণের এই অর্থ। ‘ডিজিটাল মুজিব’ তৈরিতে ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ, চ্যাটবট, হলোগ্রাফিক প্রজেকশন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (ভিআর) মত প্ল্যাটফর্মের নামে একটি প্রকল্প থেকেই এসব অর্থ খরচ হয়। এসব কাজের দরপত্রও পায় শেখ পরিবার এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ঘনিষ্ঠরা। বিপুল অর্থ খরচের বিপরীতে নিম্নমানের কাজ জমা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে “মোবাইল গেইম ও এ্যাপ্লিকেশন এর দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক” প্রকল্প গৃহীত হয়। ৩৩০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল মোবাইল গেম এবং স্মার্টফোনভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন তথা অ্যাপ তৈরিতে দেশজুড়ে দক্ষ জনবল তৈরি করা। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজের বিশ্লেষণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আর তার স্বজনদের নিয়েই নানান কর্মকাণ্ড দেখা যায়। প্রকল্পের ১০ শতাংশের বেশিই খরচ হয়েছে শেখ মুজিব এবং শেখ রাসেলের শ্রাদ্ধে।
প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ সম্পর্কিত এক নথি অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য ‘মুজিব জিজ্ঞাসা’ নামক একটি চ্যাটবট বানিয়েছে প্রকল্প কার্যালয়। এই ট্রাস্টের চেয়ারপারসন ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের নভেম্বরে এই চ্যাটবট তৈরির কাজ দেওয়া হয় ‘হেডলেস টেকনোলিজ লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রকল্প নথি বলছে কাজটি সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ট্রাস্টকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘মুজিব জিজ্ঞাসা’ ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি ‘ইন্টারএকটিভ চ্যাটবক্স’ রয়েছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, চ্যাটজিপিটি’র মত যেকোন কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সম্পন্ন চ্যাটিং প্ল্যাটফর্মেই এধরনের কাজ সম্ভব। ওয়েবসাইটটিতে দেওয়া গুগল প্লে-স্টোর অ্যাপে গিয়ে দেখা যায়, অদ্যবধি মাত্র পাঁচ শতাধিকের কিছু বেশিবার অ্যাপটি ডাউনলোড হয়েছে। আর এতেই চ্যাটবটটির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৭১ লাখ টাকা।
একই ট্রাস্টের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু অভিধান’ নামে আরেকটি ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি হয়েছে এই প্রকল্পের টাকায়। ৭৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ের এই কাজটি পেয়েছে ‘প্রাইম টেক সলিশনস লিমিটেড’। ২০২৩ সালের মে’তে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কাজটি ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে এই অভিধান কোথায় কী কাজে কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি। শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনে ‘মুজিব ১০০ ডট গভ ডট বিডি’ ওয়েবসাইটের বিপরীতে মোবাইল অ্যাপ তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। কাজটি করেছে ‘ইজি টেকনোলজি লিমিটেড’। ট্রাস্টের জন্য ‘রাসেল সোনা’ নামে একটি ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন চলচিত্রও তৈরি করা হয়েছে এই প্রকল্পের টাকায়। ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকারও বেশি ব্যয়ে চলচিত্রটি বানানোর কাজ যৌথভাবে পেয়েছে ‘স্কেচ স্টুডিও লিমিটেড’ এবং ‘স্পিনঅফ স্টুডিও’। স্পিনঅফের প্রধান নির্বাহী এএসএম আসাদুজ্জামান পলকের খুব ঘনিষ্ঠজন হিসেবে আইসিটি বিভাগে পরিচিত। মাত্র ২৩ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এ অ্যানিমেশন ফিল্মটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে খরচ ১৩ লাখ টাকা।
শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের জন্য আরও একটি অ্যানিমেশন চলচিত্র তৈরি করেছে আইসিটি বিভাগের এই প্রকল্প। শেখ হাসিনার লেখা ‘মুজিব আমার পিতা’ বই অবলম্বনে ‘মুজিব আমার পিতা’ অ্যানিমেশন চলচিত্রটি মুক্তি পায় ২০২১ সালের ১ অক্টোবর। ৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচিত্রটির জন্য মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থ্যাত প্রতি মিনিটের জন্য ব্যয় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। কাজটির দরপত্র পেয়েছিল ‘বিএমআইটি সলিউশনস লিমিটেড’। তবে জানা যায়, এর অ্যানিমেশন তৈরিতে কাজ করেছে প্রোলান্সার স্টুডিও। সরকারি খরচে যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমাটির বিশ্ব প্রিমিয়ার করে আইসিটি বিভাগ। এ সিনেমার গবেষণা সমন্বয়ক ছিলেন আওয়ামী লীগের (এএলবিডি) ওয়েব টিমের সমন্বয়কারী তণ্ময় আহমেদ। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বিপুল অর্থায়নে নির্মিত আরেকটি অ্যানিমেশন সিরিজ ‘খোকা’। ৯৩ মিনিটের এ অ্যানিমেশন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১১ পর্বের এ অ্যানিমেশন সিরিজের পরিচালনায়ও ছিলেন প্রোলান্সার স্টুডিওর সোহেল মোহাম্মদ রানা। ২০২৩ সালের ২৩ জুন মুক্তি পায় ৪৩ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের আরেক অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘মুজিব ভাই’। ৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ের এই চলচিত্রটি নির্মাণের কাজ পায় টেকনোম্যাজিক প্রাইভেট লিমিটেড। সহযোগী ছিল হাইপার ট্যাগ লিমিটেড। এর গবেষণার নেতৃত্বেও ছিলেন তণ্ময় আহমেদ। পরিচালনা করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন জিনাত ফারজানা, আরিফ মোহাম্মদ ও মো. শফিউল আলম। ‘মুজিব ভাই’ অ্যানিমেশনের পেছনে প্রতি মিনিটে খরচ হয়েছে সাড়ে ১১ লাখ টাকা।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মুজিব জাদুঘরে এবং রাজশাহী হাইটেক পার্কে ৭ মার্চে শেখ মজিবুর রহমানের ভাষণকে কেন্দ্র করে হলোগ্রাফিক প্রজেকশন এবং থিয়েটারও তৈরি করা হয়েছে এই প্রকল্পের টাকায়। লেজারের আলোটে শেখ মুজিবের অবয়ব এবং ‘ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক’ এর মাধ্যমে ৭ মার্চের আবহ তৈরির এই কাজটিতে ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের কারও পেছনে এই প্রকল্পের অধীন সর্বোচ্চ অর্থায়নের কাজটি পেয়েছে এনডিই সলিউশন। তবে এধরনের কাজ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধু শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে কাজটি এনডিই’কে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্পের অর্থায়নে শেখ মুজিবের ডিজিটাল সংস্করণে এমন অর্থ খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির বর্তমান পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকল্প কার্যালয় থেকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী ডিজিটাল রিসোর্স তৈরি করে দেওয়া হতো। তবে শেখ মুজিব সম্পর্কিত এসব কাজের দরপত্র আমার আগে দেওয়া হয়েছিল। বলতে গেলে একদম শেষের দিকে এসে আমাকে পরিচালক করা হয়েছে। আমার মূল দায়িত্ব এখন প্রকল্প সমাপ্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা। আমার আগে যারা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এসব কাজ দিয়েছেন তারা এগুলো সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ মুজিব সম্পর্কিত বেশিরভাগ কাজগুলোর দরপত্র দেওয়া হয়েছে সাবেক প্রকল্প পরিচালক আনোয়ারুল ইসলামের সময়ে। এ বিষয়ে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এই কাজগুলো সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের পলকের নির্দেশনায় অগ্রাধিকভার ভিত্তিতে করা হয়েছিল। তবে সবকিছুই আইসিটি বিভাগের অনুমোদনে হয়েছিল।
এধরনের কাজ আইসিটি বিভাগের আওতা এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না বলে মনে করছেন আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘস্থায়িত্ব নেই অথবা আইসিটি খাতে অবদান রাখে না এমন কর্মকাণ্ডে এধরনের অর্থ খরচের বিরোধিতাও করছেন তারা। আইসিটি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, এই কাজগুলো আইসিটি বিভাগের কাজের মধ্যে পড়ে কিনা, সেটা দেখতে হবে। এই কাজগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করতে পারতো। তাছাড়া এসব কাজের সাথে আইসিটি বিভাগের যে উদ্দেশ্য দেশকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করা, আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান এবং দক্ষ জনগল তৈরি করা; সেসব উদ্দেশ্যের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাশাপাশি এগুলোর কোন দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই অবদান নেই। কাজেই এধরনের কাজে রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ ব্যয়ের আগে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।