ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর, আইসিটি খাতের সরকারি ভেঞ্চার ফান্ড পরিচালনার নামে স্টার্টআপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি আহমেদ এখনো বহাল থাকায় উদ্যেক্তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে নানা শংকা। ২০২২ সালে শেখ হাসিনা পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তাকে এখন আর কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না। গত আট মাসেও তাকে না সরিয়ে উল্টো একই পদে বহাল রাখায় আইসিটি খাতে বিরাজ করছে ক্ষোভ। অভিযোগ, সামি আহমেদ দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে জয়-পলকের প্রভাব খাটিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের আওতায় সরকারি ভেঞ্চার ফাের কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বন্টনে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুবৃত্তায়নকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। জুলাইয় রক্তাক্ত আন্দোলন নস্যাৎ করতে স্টার্টআপ সামিট আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি ছিল ফ্যাসিস্টকে টিকিয়ে রাখার কোশল।
স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ পাওয়া আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলআইসিটি প্রকল্পে আইটি-আইটিইএস পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পান সামি আহমেদ। সূত্র মতে, এ কাজে তার প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা, উদ্যোক্তা অভিজ্ঞতা বা বড় পরিসরে সংগঠন পরিচালনার দক্ষতার অভাব রয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের অক্টোবরে এটুআই প্রোগ্রামে ‘টেকনোলজি এক্সপার্ট’ হিসেবে নিয়োগ পান এবং সেখানে ছিলেন এক বছর আট মাস। ২০১৪ সালে সফটওয়্যার খাতের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠন বেসিসের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। দায়িত্ব গ্রহণের ১ বছরের মধ্যেই শত কোটি টাকা বিনিয়োগ দিয়েছেন নিজের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে। কাছের মানুষ বা রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে তিনি সরকারি ফান্ড দিয়েছের তার বেশিরভাগই গেছে বিফলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনৈতিকভাবে সামি আহমেদের অনুদান দেওয়া স্টার্টআপগুলোও আলোর মুখই দেখেনি। স্টার্টআপ বাংলাদেশের থেকে অনুদান নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ড্রাইভারবিডিডটকম। ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় এ প্রতিষ্ঠানকে। এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা অনুদান নেওয়া স্মার্ট বেড ও হুইলচেয়ার তৈরির ‘ফাইভডি টেকনোলজিও এখন আর কার্যকর নেই। সরকারি টাকা গেছে জলে।
চার বছর ধরে একটি স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করা উদ্যোক্তা রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প যথেষ্ট ভালো হলেও শুধু রাজনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় আমরা সরকারি বিনিয়োগ পাইনি। অন্যদিকে, অনেক দুর্বল প্রকল্প রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে অনায়াসে বিনিয়োগ পেয়েছে।’
নিজের দুর্নীতি ও অনিয়মকে লোকচক্ষুর আড়াল করতে আইসিটি ভবনের অফিস থেকে আলাদা স্থানে স্টার্টআপ বাংলাদেশের অফিস স্থানান্তর করেন সামি। আওয়ামী লেীগের পতনের পর সামি আহমেদ কিছুদিন গা ঢাকা দেন। পরে অবশ্য খোলস পালটে কার্যক্রম শুরু করেন। কমিশন বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে তার রয়েছে পরামর্শক বাহিনী।
সূত্র জানায়, ১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈকে হত্যার দিন বিকেলে সামিট আয়োজন নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন সামি। দেশের আইটি ও স্টার্টআপ খাতের শীর্র্ষ উদ্যোক্তাদের ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া ‘পাঠাও’ সিইও ফাহিম আহমেদ জানান, আমি সামিকে বলেছিলাম দেশের এমন পরিস্থিতিতে সামিট আয়োজন অপ্রাসঙ্গিক। তরুণরা আন্দোলনে রাস্তায়। রক্ত ঝরছে তাদের। এমন সময় তরুণদের উদ্দেশ্যে এই ইভেন্ট মানায় না। জবাবে সামি বলেছিলেন, এই আন্দোলন বড় কিছু না, দরকার হলে গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় সামিট আয়োজন করব।
এদিকে ৫ আগস্টের পর ‘পাঠাও’ সিইও সামিকে পদত্যাগের আহ্বান জানান। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক সভায় ফাহিম ও সামির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। ফাহিম বলেন, আন্দোলনের সময় তার ভূমিকা বিতর্কিত ছিল। তরুণদের প্রতিনিধি হয়ে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের পক্ষ নেওয়ায় পদে থাকার তার নৈতিক অবস্থান নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি এডটেক প্রতিষ্ঠান ‘টেন মিনিট স্কুল’ ও ‘শিখো’ নিগ্রহের শিকার হয়। ‘জুলাই আন্দোলন’-এর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় টেন মিনিট স্কুলের ৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবিত বিনিয়োগ বাতিল করে বাংলাদেশ স্টার্টাপ লিমিটেডের (এসবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি আহমেদ। একইভাবে, ‘শিখো’ প্লাাটফর্মে বিনিয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেও তা বাতিল করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হকের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বঙ্গ’-তে ২০২৩ সালের আগস্টে পলকের উপস্থিতিতে ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ স্টার্টআপ লিমিটেড। এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন সামি। এছাড়া ‘বঙ্গ’ আয়োজিত ‘শার্ক ট্যাংক’ অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তিনি। বিতর্কিত ‘নগদ’-কেও রাজনৈতিক সুবিধায় এগিয়ে নিয়েছেন সামি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক প্রতিষ্ঠিত স্টার্টআপ সিইও জানান, সামির আয়োজিত স্টার্টআপ সামিটগুলোতেই বোঝা যায়, কাদের তিনি সুবিধা দিয়েছেন। এমনকি নগদের সাবেক এমডি তানভীর এ মিশুককে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে ৪০ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগও করে দেন সামি।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ স্টার্টআপ কোম্পানির বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছেন সামি আহমেদ, যা নিয়মবহির্ভূত। ‘শার্ক ট্যাংক’ রিয়েলিটি শো’র প্রথম সিজনে তিনি অন্তত ১৪টি স্টার্টআপে বিনিয়োগ বা অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। অথচ কোম্পানির গাইডলাইনে বিনিয়োগের জন্য রয়েছে ৭টি ধাপ ও বোর্ডের অনুমোদন বাধ্যবাধকতা। এসব ধাপে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণসহ একাধিক বিষয় পর্যালোচনা করার কথা। কিন্তু সামি আহমেদ নিজে থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থের বরাদ্দ দেন। যা ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সামি আহমেদের নিগ্রহের শিকার এক উদ্যক্তা জানান, অন্তরর্বর্তী সরকার প্রতিটি সেক্টরের দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্টের সহযোগীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। অথচ সামি আহমেদের মতো দোসর এখনো পদে বহাল থেকে কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া এক বড় রহস্য।
এদিকে, সামি আহমেদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দাবি ওঠেছে বৈষম্যবিরোধী আইটি ও উদ্যোক্তা পরিষদের পক্ষ থেকে। তার অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা। ‘আইসিটি স্টেকহোল্ডারস’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে এ কর্মসূচি হয়। সম্প্রতি তারা আগারগাঁওয়ে আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরীর কার্যালয়ে ১৪ দফা দাবি পেশ করেন। প্লাটফর্মটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জুয়েল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা চাই সারা দেশে প্রকৃত উদ্ভাবকদের সহায়তা করতে একটি ন্যায়সঙ্গত স্টার্টআপ অর্থায়ন ব্যবস্থা।’
প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে থাকা ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব জানান, সামির অপসারণের জন্য যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছি। আন্দোলনকারীদের সামিট পর্যন্ত অপেক্ষার অনুরোধ করা হয়েছিল। ‘তার (সামি) বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। তাকে ইতোমধ্যে নোটিস প্রদান করা হয়েছে’। ‘শিগ্গির স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেওয়া হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলমান রয়েছে। আমরা চাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে জনগণের আস্থা ফিরে আসুক।’
এসব বিষয়ে জানতে সামি আহমেদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ দিলেও তিনি সেটার সাড়া দেননি।