ভোক্তাদের কোটি টাকার ফাঁদে ফেলে আলোচিত ‘আমার পে’ পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এ এম ইশতিয়াক সারওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। এর মাঝেই উঠেছে নতুন প্রশ্ন—তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কি তার লাইসেন্সপ্রাপ্তিতে কোনো ভূমিকা রেখেছিল?
যারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন, তারা বলছেন, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ছাড়পত্র ছাড়া দেশের কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায় না। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহলের অনুমোদন বা সুপারিশ ছাড়া লাইসেন্স পাওয়া প্রায় অসম্ভব। দেশে এখন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৯টি পিএসও (পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর) আছে ।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা বলছেন, “আমার পে” যে ধরণের আর্থিক অনিয়ম করেছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও এখনো প্রতিষ্ঠানটি সক্রিয়—এটা কি শুধু ব্যবসায়িক কৌশল, নাকি প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়া?
বিভিন্ন সূত্র বলছে, ইশতিয়াক সারওয়ার সরাসরি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন এবং একাধিক প্রকল্পে ‘আমার পে’কে সিস্টেম ইন্টিগ্রেটরের জায়গা দিতে প্রভাব খাটানো হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ‘আমার পে’ দীর্ঘ সময় ধরে নির্ধারিত সময়ে রিফান্ড দিচ্ছে না। বরং নতুন নতুন তারিখ দিয়ে গ্রাহককে শুধু ঘোরাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে পুরনো অফিস বন্ধ করে ফেলেছে। নতুন অফিসের অবস্থান জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর দিচ্ছে না তারা।
ভুক্তভোগী গ্রাহকের ফেসবুকে কান্না
গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক কার্ড ইউজার্স অব বাংলাদেশ নামের ফেসবুক গ্রুপে ‘আমার পে’র বিরুদ্ধে ৬ লাখ টাকা আটকে রাখার অভিযোগ করেন রিজোয়ান আহমেদ নামের এক ভুক্তভোগী। তিনি লেখেন,
“টাকা চাইলে শুধু সময় দেয়, সেই সময় আর শেষ হয় না। তারিখ দিয়ে তারিখ দেয়, কখনো রিপ্লাইই দেয় না। অফিস কোথায় সেটাও বলে না।”
এই পোস্টের নিচে একে একে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে থাকেন অন্য গ্রাহকরাও। কেউ বলেন “পুরো ব্যবসা ধ্বংস করেছে”, কেউ বলেন “মাসের পর মাস ঘুরেও টাকা ফেরত পাননি”।
রিজোয়ান হায়দার নামে এক ভুক্তভোগী মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, মাথা নষ্ট অবস্থা, বছর পাঁচেক আগে একসময় এই কোম্পানির পেমেন্ট গেটওয়ে ক্লায়েন্ট ছিলাম, ৬ মাসের মধ্যে কান ধরে তওবা করে বের হয়ে গেছি।
মোহাম্মদ সোহানুর রহমান সাকিব লিখেছেন, সেটেলমেন্ট ঠিকমত দেয় না দেখে এদের গেটওয়ে ব্যবহার করা গত বছর থেকেই বন্ধ করেছি।
সামাদ আহমেদ নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ‘আমার পে’ তার একটি রানিং ব্যবসা শেষ করেছে। ২ বছর ধরে পুরো টাকা হোল্ড করে রেখেছিলো কোন কারণ ছাড়াই। এরা বাংলাদেশে বিজনেস করে কেমনে বুঝি না। পুরাই স্ক্যাম।
মোহাম্মদ সালেহুর রহমান নামে আরেক ভুক্তভোগী ঐ পোস্টের মন্তব্যের ঘরে বলেন, আপনি তো অনেক বড় অ্যামাউন্ট স্ক্যাম হয়েছেন। আমি নিজেও ভুক্তভোগী তবে অ্যামাউন্টটা ছোট। ৬ মাস হলো আটকে রেখেছে এবং তাদের সেটেলমেন্ট কখনোই টাইমলি ছিলো না। বাধ্য হয়ে অন্য গেটওয়ে তে মুভ করতে হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নেয়া উচিত!
আসিফ খান চিশতী নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার প্রায় চার লাখ টাকা আটকে রাখছে। টাকা রিফান্ডের কারো কোনো ওয়ে জানা থাকলে অথবা কেউ টাকা ফেরত নিয়ে দিতে পারলে জানাবেন। প্রয়োজনে ২৫ শতাংশ হাদিয়া দেব।
জবাবে প্রতিষ্ঠানটি
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘আমার পে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম ইশতিয়াক সারওয়ার টেকজুম .টিভিকে বলেন, পেমেন্ট গেটওয়ে লাইসেন্স পেতে তিনি কোন অনৈতিক সুবিধা নেননি। সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই । গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত করেও কিভাবে পেমেন্ট গেটওয়ে লাইসেন্স জানাতে চাইলে তিনি বলেন এই বিষয়েআপনাকে বলব না বাংলাদেশ ব্যাংক আর আমাদের বিষয় ।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায় নগদ লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক এবং আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট এর সাথে তার সখ্যতা কারনে পলকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবাখাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) ২০২৪-২৬ মেয়াদের কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচনী টিম স্মার্ট’ নিয়াজ মোর্শেদ এলিট প্যানেলের হয়ে নির্বাচন ও করেছেন ।
তিনি আরও দাবি করেন, “আমাদের মোট গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। অভিযোগ রয়েছে ৫০ জনের মতো গ্রাহকের। আটকানো টাকার পরিমাণ দেড় কোটি টাকা।”
দায় নেবে কে?
ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের এমন অনিয়ম নতুন কিছু নয়। তবে ‘আমার পে’ বিষয়ক অভিযোগের সংখ্যা ও ধরন অত্যন্ত ভয়াবহ। যেখানে গ্রাহকের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা, সেখানে পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানই যদি অর্থ আত্মসাৎ করে, তাহলে কার ওপর ভরসা করবেন সাধারণ মানুষ? দেশের পেমেন্ট গেটওয়ে খাতে নজরদারির অভাব এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি কি এই অনিয়মকে উৎসাহ দিচ্ছে না? এই প্রশ্ন এখন উঠেছে খোদ ভুক্তভোগীদের মধ্যেই।