বছরের পর বছর ধরে চলছে ঘোষণার পর ঘোষণা। কখনো বিটিআরসি, কখনো এনবিআইএমএস, আবার কখনো ‘আইএমইআই ভেরিফিকেশন সিস্টেম’ চালুর ঘোষণা—কিন্তু বাস্তবে অবৈধ বা চোরাই মোবাইল ফোন বন্ধে সরকার এখনো সফল হতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে প্রতিমাসে গড়ে ২–৩ লাখের বেশি অবৈধ মোবাইল ফোন প্রবেশ করছে, যার বেশিরভাগই এয়ার কার্গো, লাগেজ পার্টি বা সীমান্তপথে আসে। ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। একই সঙ্গে ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে এইসব ফোন, যেগুলোর কোনো নিবন্ধন বা ট্র্যাকিং নেই।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২১ সালে এনবিআইএমএস (National Equipment Identity Register) চালু করে। এর মাধ্যমে বলা হয়েছিল, অবৈধ আইএমইআই নম্বর বিশিষ্ট ফোনগুলো আর মোবাইল নেটওয়ার্কে সক্রিয় হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এখনও এসব ফোন নির্ধারিত অপারেটর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারছে অনায়াসে।
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সিস্টেম চালু থাকলেও রাজনৈতিক চাপ, অপারেটরদের অসহযোগিতা ও আমদানি লবির প্রভাবের কারণে কার্যকরভাবে অবৈধ ফোন বন্ধ করা যাচ্ছে না।”
মোবাইল অপারেটরদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা শুধু বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী চলে। কিন্তু এনবিআইএমএস প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তাদের সার্ভার ও বাস্তবসম্মত একীকরণ এখনো পুরোপুরি হয়নি। ফলে তারা প্রতিটি ফোনের আইএমইআই যাচাই করে নেটওয়ার্ক ব্লক করতে পারছে না।
দেশীয় মোবাইল ব্র্যান্ডগুলো বলছে, অবৈধ ফোনের কারণে তারা বৈধভাবে শুল্ক দিয়ে উৎপাদন করেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ‘অপসন মোবাইল’ নামের একটি দেশীয় ব্র্যান্ডের কর্মকর্তার অভিযোগ, “১০–১৫ শতাংশ কম দামে চোরাই ফোন বাজার দখল করছে। এতে আমরা হুমকির মুখে।”
দেশীয় মোবাইল কোম্পানিগুলোর একজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দেশে মোবাইল উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয় প্রচুর ডলার খরচে। অথচ সেই ফোন যখন বাজারে আসে, তখন একই দামে অবৈধভাবে আসা চাইনিজ ফোন বা রিফারবিশড সেট আমাদের বাজার হারিয়ে দেয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কর দিয়ে ফোন বানাই, অথচ আমদানি করা চোরাই ফোন কোনো শুল্ক ছাড়াই অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতা অসম হয়ে পড়েছে।”
২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন ক্রয় করা ফোনের নিবন্ধন না হলে সেটি বন্ধ করে দেওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে এখনো পুরোনো ও নতুন—দুই ধরনের অবৈধ ফোন-ই নেটওয়ার্ক পাচ্ছে। এমনকি কিছু ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন, রেজিস্ট্রেশন থাকা সত্ত্বেও ফোন অকার্যকর হয়েছে।
অবৈধ ফোন বাজারে ফ্ল্যাশিং করে আইএমইআই নম্বর বদলে বৈধ ফোন হিসেবে চালানো হচ্ছে। আইএমইআই নম্বরের ঘন ঘন পরিবর্তন শুধু অবৈধ নয়, এটি প্রযুক্তিগতভাবে নিরাপত্তা হুমকিও তৈরি করছে। অপরাধীরা এই সুযোগ ব্যবহার করছে মোবাইল নম্বর ট্রেসিং এড়াতে।
টেলিযোগাযোগ খাতের বিশ্লেষক ও গবেষক রেজাউল করিম বলেন, “আইএমইআই রেজিস্ট্রেশনের মতো টেকনিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার থাকলেও, তা আইন প্রয়োগ ও নীতিগত প্রতিশ্রুতি ছাড়া অর্থহীন। সরকার চাইলে এক মাসেই অবৈধ ফোন বন্ধ করতে পারে। প্রশ্ন হলো, আদৌ তারা সেটা চায় কি না।”
আইএমইআই নথিভুক্ত না থাকা ফোন দিয়ে অপরাধ সংঘটনের পর তা শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। পুলিশের সাইবার ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা অনেক সময় অপরাধীদের মোবাইল শনাক্ত করতে গিয়ে দেখি, ফোনটি সিস্টেমেই নেই। এতে তদন্তে বড় বাধা তৈরি হয়।”