বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাত ২০২৫ সালে এসে একদিকে পৌঁছেছে পরিবর্তনের এক নতুন পর্যায়ে, অন্যদিকে নীতিগত অনিশ্চয়তা, দুর্বল অবকাঠামো ও রাজনৈতিক প্রভাবের বেড়াজালে কিছু খাত ধুঁকেও পড়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের প্রায় দুই দশক পর এখন সময় হয়েছে এই খাতের গভীর বিশ্লেষণের—কোথায় কতদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ, আর কোন জায়গাগুলোতে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন।
বাজার চিত্র: ২০ বিলিয়ন ডলারের দ্বারপ্রান্তে
বাংলাদেশের আইটি ও টেলিকম খাতের সম্মিলিত বাজারমূল্য এখন প্রায় ১৮.৭ বিলিয়ন ডলার (BASIS ও BTRC সূত্র)। এর মধ্যে সফটওয়্যার রফতানি, ফ্রিল্যান্সিং, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং ও ই-কমার্স উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে।
-
সফটওয়্যার রফতানি: ১.৯ বিলিয়ন ডলার (২০২৫)
-
ফ্রিল্যান্সিং আয়: ১.৩ বিলিয়ন ডলার
-
মোবাইল ফোন উৎপাদন বাজার: ১০,০০০ কোটি টাকা
-
ই-কমার্স লেনদেন: মাসিক গড়ে ৬৫০ কোটি টাকা (অনুমান)
হার্ডওয়্যার: সম্ভাবনা আছে, স্থায়িত্ব নেই
দেশে বর্তমানে ১২টির বেশি মোবাইল ফোন কারখানা সক্রিয়। কিন্তু মূলধনী মেশিনারিজে ভর্তুকি নেই, অথচ আমদানিকৃত অবৈধ ফোনে শুল্ক ফাঁকি—ফলে লোকসানে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ইতোমধ্যেই ৩টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ করেছে।
-
৩৫,০০০ জন শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে যুক্ত
-
Walton, Symphony, Tecno, Xiaomi (অ্যাসেম্বলি), Realme– গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার
-
ভ্যাট-শুল্কে বৈষম্যের অভিযোগ: স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গড়পরতা ৩০% ট্যাক্স দেয়, আমদানিকারকরা অনেক ক্ষেত্রেই ফাঁকি দেয় বা অবৈধভাবে ফোন এনে বাজার সয়লাব করছে
টেলিকম খাত: নীতিগত দুর্বলতা ও দায়হীনতার অভিযোগ
৫জি এখনও পরীক্ষামূলক অবস্থায়। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বারবার লাইসেন্স ও এনওসি প্রদানে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগের মুখে পড়ছে। IIG, ITC, IGW লাইসেন্সধারী একাধিক প্রতিষ্ঠান কোটি টাকার বকেয়া রেখেও ব্যবসা চালাচ্ছে।
-
ব্যান্ডউইথ চুরি ও দাম নিয়ে বিভ্রান্তি
-
আন্তর্জাতিক গেটওয়ে রাজস্ব ফাঁকি (ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স-এর মতো উদাহরণ)
-
জেলা পর্যায়ে অবৈধ আইএসপির দৌরাত্ম্য
এআই, বিগডেটা ও স্টার্টআপ: দৃষ্টি আছে, তহবিল নেই
চলতি বছরে বাংলাদেশে এআই স্টার্টআপ সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল পাওয়া এখনো কঠিন।
-
সরকারি ইনকিউবেটর কার্যক্রম বন্ধ বা অকার্যকর
-
দেশের মাত্র ৮% স্টার্টআপ সরকারি কোনো প্রকল্প থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে (LightCastle প্রতিবেদন)
-
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ কমেছে: ২০২২-এ যেখানে ছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৪-এ তা ৯৭ মিলিয়নে নেমে এসেছে
ই-কমার্স: পরিবর্তনের মাঝেও পুরোনো ভীত
‘আমার পে’, Qcoom -এর মতো কেলেঙ্কারির পর গ্রাহক আস্থার সংকট দেখা দেয়। ফয়েজ আহমেদ তৈয়বের নেতৃত্বে ই-ক্যাবে সংস্কারের চেষ্টা হলেও মাঠপর্যায়ে এখনও বাস্তবায়ন দুর্বল।
-
রিভার্স ই-কমার্স মডেল চালু হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে
-
ডাক বিভাগের অব্যবহৃত নেটওয়ার্ক ব্যবহারের প্রস্তাব আলোচনায়
-
মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ পুনরায় মাথাচাড়া দিচ্ছে (বিশেষত ‘নগদ’ প্ল্যাটফর্মে)
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাত এখন একটি ‘ক্রসরোডে’ দাঁড়িয়ে। যদি নীতিগত স্বচ্ছতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ট্যালেন্ট উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে আগামী ৫ বছরে এই খাত হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি আয়ের উৎস।