নামমাত্র একটি এজেন্সি হিসেবে শুরু, পরে সরকারি ভাতা বিতরণের একচেটিয়া অধিকার—সবশেষে মালিকহীন এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রায় নয় কোটি গ্রাহক নিয়ে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের এমন রূপান্তর এখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে এসে ঠেকেছে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, আর্থিক জালিয়াতি, এবং রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২৭ মে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে নগদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হস্তান্তর করা হয় ডাক বিভাগের কাছে।
শ্যামল দাসের পদত্যাগ, আবু তালেবের দায়িত্ব গ্রহণ
নগদের ভারপ্রাপ্ত সিইও শ্যামল বি দাস ডাক বিভাগের মহাপরিচালকের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়ে মালিকানা, শেয়ার ও অপারেশনাল সব দায়িত্ব হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, “অস্বাভাবিকভাবে আমার দায়িত্ব একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। আমি যাদের অধীনে কাজ করছিলাম তারা পলাতক এবং বেআইনি নির্দেশ দিচ্ছিলেন।”
পরিস্থিতি বিবেচনায় সভায় উপস্থিত কর্মকর্তারা সর্বসম্মতিক্রমে নগদের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ডাক বিভাগের পরিচালক আবু তালেবকে প্রদান করেন।
২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হদিস নেই
নগদের বর্তমান প্রশাসনিক জটিলতার পেছনে রয়েছে বিশাল অঙ্কের অর্থ কেলেঙ্কারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটে দেখা যায়, ২,৩৫৬ কোটি টাকার ই-মানির কোনও বৈধ হিসাব নেই। এসব অর্থ কীভাবে তৈরি হলো, কোথায় গেল—তার সঠিক উত্তর এখনো মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি ও অনলাইন জুয়া-মানি লন্ডারিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এসব অ্যাকাউন্ট।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নগদের উত্থান
২০১৭ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানটিই ‘নগদ’ নামে রি-ব্র্যান্ড হয় এবং ২০১৯ থেকে ব্যাপকভাবে সরকারি ভাতা বিতরণে যুক্ত হয়। আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এর পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন, যাদের সময়েই একের পর এক অনিয়ম ঘটেছে।
সরকার পতনের (৫ আগস্ট ২০২৪) পর অন্তর্বর্তী সরকার নগদে প্রশাসক নিয়োগ করে এবং তদন্ত শুরু হয়। এ পর্যন্ত ২৪ জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করেছে।
প্রশাসনিক সংকটে গ্রাহক সেবা ঝুঁকিতে
শ্যামল দাস তার আবেদনে বলেন, “চুক্তিপত্র, নিয়োগপত্র, কিংবা বৈধ ডিজিটাল স্বাক্ষর ছাড়া একজন সিইও হিসেবে এত বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা অসম্ভব। আমি দেশের কোটি মানুষের অর্থ নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাই না।”
এই অবস্থার কারণে নগদের নিয়মিত সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। হাজার হাজার এজেন্ট ও কর্মী ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না, বিভিন্ন জেলায় ক্যাশ আউট কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ছে, গ্রাহকের আস্থা নড়বড়ে।
নতুন ব্যবস্থাপনার অঙ্গীকার
ডাক বিভাগের অধীনে নতুনভাবে দায়িত্ব নেওয়া আবু তালেব বলেন, “গ্রাহক সেবা স্বাভাবিক করতে ঈদের আগেই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-বোনাস নিশ্চিত করা হবে। অনলাইন জুয়া, জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
নতুন ব্যবস্থাপনা আরও জানায়, এক এনআইডিতে একাধিক অ্যাকাউন্ট, ভুয়া এজেন্ট, ভুয়া ডিস্ট্রিবিউটর—সব বাতিল করা হবে। সরকারকে সহযোগিতা করে নগদকে স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
সার্বিক মূল্যায়ন
নগদের আর্থিক অনিয়ম ও অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা আজ রাষ্ট্রের ওপর এক বিশাল চাপ তৈরি করেছে। এত বড় অঙ্কের জালিয়াতির পরও দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে চলেছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। এখন, ডাক বিভাগের হাতে মালিকানা গেলে কতটা স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে অন্তত আপাতত রাষ্ট্র নিজেই নগদকে নিজের ঘরে টেনে এনেছে, যাতে এর আর্থিক ঝুঁকি জনগণের ওপর না পড়ে।