অনুমোদন ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার (ফরেক্স) ট্রেডিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও লাইসেন্সবিহীন ডিজিটাল অর্থ (ভার্চুয়াল মানি) তৈরি-লেনদেন দেশের প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ। অথচ এমন অবৈধ কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন ‘নেক্সট ভেঞ্চার’ ও ‘ফান্ডেড নেক্সট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ জায়েদ।
স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সেসময় নির্বিঘ্নে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান তিনি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন জায়েদ।
অভিযোগ উঠেছে, পলকসহ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে জায়েদের হাতে। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা মামলাও রয়েছে।
ঢাকার বিজ্ঞ মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলাটি করেন টাঙ্গাইলের আশরাফ আলী নামে এক ব্যক্তি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ‘নেক্সট ভেঞ্চার’ প্রতিষ্ঠা করেন জায়েদ। আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেশে ব্যবসা শুরু করলেও একপর্যায়ে শুরু করেন ফরেক্স ও ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা। এজন্য ২০২২ সালে গড়ে তোলেন ‘ফান্ডেড নেক্সট’ প্রতিষ্ঠান। তবে জায়েদ নিজের প্রভাব জাহির করেন ২০২৩ সালের জুলাইয়ে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমি মার্টিনেজকে ঢাকায় এনে।
‘ফান্ডেড নেক্সট’-এর অফিস ও কার্যক্রম রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমান, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ডস, সাইপ্রাস, হংকং ও শ্রীলংকায়।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে বিদেশে অর্থ নেননি জায়েদ। বাংলাদেশসহ এসব দেশে অবৈধ ফরেক্স ও ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে এবং দেশে-বিদেশে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। তার বিলাসিতার কাছে হার মানবে যে কোনো ধনকুবেরও।
-
অবৈধ ফরেক্স ও ক্রিপ্টো ব্যবসায় কোটি টাকার মালিক ‘ফান্ডেড নেক্সট’ প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ জায়েদ
-
সৈয়দ আব্দুল্লাহ জায়েদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও ক্রিপ্টো প্রতারণার অভিযোগ
-
অনুমোদনহীন ফরেক্স ও ভার্চুয়াল মানি: ফান্ডেড নেক্সটের কর্ণধার জায়েদের অর্থ পাচার চক্র
-
বিটকয়েন বাণিজ্যে বাংলাদেশের কালো টাকা বিদেশে পাচার, কেন্দ্রে জায়েদ ও ‘নেক্সট ভেঞ্চার’
-
আইনভঙ্গ করে কোটি টাকা পাচার: ফান্ডেড নেক্সট প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে পলকসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার নির্বাচনে স্পন্সর করেছেন জায়েদ। কালোটাকার দাপটে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসেও (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) বাগিয়েছেন পরিচালক পদ। আওয়ামী লীগ আমলে ২০২৪ সালের ৮ মে অনুষ্ঠিত বেসিস নির্বাচনে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ভোট কিনেন তিনি।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, জায়েদ বাংলাদেশের ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয়-বিক্রয়সহ মানি লন্ডারিং ও অনলাইন প্রতারণার অন্যতম হোতা। অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার জন্য নানা ধরনের ছলচাতুরী, কূটকৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তিনি এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। জায়েদ দেশের ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচার মাস্টারমাইন্ড। কয়েক বছর ধরে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে প্রতারিত করছেন।
ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। দেশের আইন অনুযায়ী, বিটকয়েনের মতো যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ। লেনদেনে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার হলে তা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ও দুর্নীতিবিরোধী আইন লঙ্ঘন করবে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন অর্থ পাচার হিসাবেও বিবেচিত হবে। জায়েদের ‘ফান্ডেড নেক্সট’ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এসব অভিযোগের বিষয়ে সৈয়দ আব্দুল্লাহ জায়েদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়েও এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা কী : বিশ্বের সর্বপ্রথম মুক্ত সোর্সের ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রার নাম বিট কয়েন। যাতে লেনদেন করতে প্রয়োজন হয় না কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার। ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতা ছদ্মনামের কোনো এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিট কয়েনের প্রচলন শুরু করে। যদিও পরে এই নামে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি এখন পর্যন্ত। বর্তমানে একেকটি বিট কয়েনের মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে চলছে এই ব্যবসা। ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছে এ লেনদেনকে। তবে বাংলাদেশ ২০১৪ সালে অবৈধ ঘোষণা করে বিট কয়েন লেনদেন। তারপরও কালোটাকা দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বা অবৈধ মাদক ব্যবসা, অস্ত্র, অবৈধ যন্ত্রপাতি কেনাবেচায় ব্যবহার হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি। বিশ্বে বর্তমানে বিভিন্ন রকমের ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে-বিট কয়েন, ইথেরিয়াম, লাইট কয়েন, মনেরো, জেড ক্যাশ, এক্সআরপি, টিথার, ইউএসডিসি কয়েন ইত্যাদি। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালের ২৯ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি বিভিন্ন জায়গায় লেনদেন হচ্ছে। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে না। ফলে এ মুদ্রার বিপরীতে কোনো আর্থিক দাবি স্বীকৃত নয়। এসব মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন করে না। তথ্য যুগান্তর