দীর্ঘমেয়াদের পরনির্ভরশীলতা কমাতে নিজস্ব চিপ তৈরিতে জোর দিচ্ছে চীন। এ উদ্যোগে চীন সফল হলে মার্কিন চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যায়ে যেতে চীনের এক থেকে দুই দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর সিএনবিসি।
গত মাসে চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এখন হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
বিশ্বের শীর্ষ টেলিকম সরঞ্জাম নির্মাতা হুয়াওয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের জন্য বেশ কয়েকটি মার্কিন কোম্পানি এবং সফটওয়্যারের জন্য গুগল ও মাইক্রোসফটের ওপর নির্ভরশীল।
এ পরিস্থিতিতে চীনের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর শিল্প উন্নয়নের পরিকল্পনা চীন কখনই গোপন রাখেনি। অন্তত বছর দুয়েক ধরে এ নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ ও হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা এ উদ্যোগে গতি এনেছে।
চীনভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিওয়াইজের বিশ্লেষক গু ওয়েনজুন সিএনবিসিকে বলেন, হুয়াওয়ের এ ঘটনা চীনের নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর শিল্প উন্নয়নের উদ্যোগ ত্বরান্বিত করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
চীন সরকারের অনেক পরিকল্পনার মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক একটি হলো সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। বেইজিং ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চমানের প্রযুক্তিপণ্য তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রয়োজনীয় সেমিকন্ডাক্টরের অন্তত ৪০ শতাংশ ২০২০ সালের মধ্যে এবং ৭০ শতাংশ ২০২৫ সালের মধ্যে তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে চায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশ। এ লক্ষ্যে সরকার অন্তত ১ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। গত মাসে দেশীয় সেমিকন্ডাক্টর ও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর জন্য কর অবকাশ সুবিধারও ঘোষণা এসেছে।
যেখানে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ১৬ শতাংশ চিপ চীনে তৈরি হয়। আবার এর অর্ধেক পরিমাণ তৈরি করে চীনা কোম্পানি। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিবেদনে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে। তার মানে চীন এখনো মূলত বিদেশী কোম্পানি, বিশেষত মার্কিন কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল।
নিজস্ব চিপ তৈরিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল বলা যায় হুয়াওয়েকে। স্মার্টফোনের জন্য কিরিন সিরিজের প্রসেসর বানিয়েছে হুয়াওয়ে। এছাড়া সর্বাধুনিক মোবাইল ইন্টারনেট প্রযুক্তির জন্য ফাইভজি মডেমও বানিয়েছে তারা। হুয়াওয়ের চিপ ডিজাইন করে কোম্পানির সহায়ক (সাবসিডিয়ারি) প্রতিষ্ঠান হাইসিলিকন।
চীনের অন্যান্য বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব চিপ তৈরির পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে স্মার্টফোন নির্মাতা শাওমি গত বছর সিএনবিসিকে জানায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির উপযুক্ত চিপ বানানোর চিন্তা করছে তারা। আলিবাবা এরই মধ্যে এআই প্রসেসর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
হুয়াওয়ের চিপ ডিজাইন করে হাইসিলিকন। ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশনের (আইডিসি) হিসাবে, এটি চীনের বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি। এই চিপ তৈরি করে আবার তাইওয়ানের একটি কোম্পানি।
ফলে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প উন্নয়নে সরকারের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা ঢেলে দেয়ার পরও চীনের যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে যেতে দুই দশক পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। মার্কিন কোম্পানিগুলো নাগালের বাইরে থেকে গেলে চীনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে নতুন সরবরাহক খুঁজে নেয়া।
তবে আইডিসি ও কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের গবেষকরা বলছেন, বিপুল বিনিয়োগের পাশাপাশি মেধাবী জনবল এবং অংশীদার খুঁজে নিতে পারলে চীন দ্রুতই সেমিকন্ডাক্টরের বাজারে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারবে।
চীনের এ পদক্ষেপ মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ। আইসিওয়াইজের গু ওয়েনজুন বলেন, নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম তৈরির লক্ষ্যে চীন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দিতে পারে। ফলে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্থান সংকুচিত হবে। তাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হুয়াওয়েকে কালো তালিকাভুক্ত করায় এরই মধ্যে গুগলসহ একাধিক মার্কিন কোম্পানি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।