আগামী বছর নাগাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফাইভজির বাণিজ্যিক প্রচলন শুরু হতে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও সেবাটি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফাইভজি চালুর পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা ও নীতিমালা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। প্রস্তাবনা ও নীতিমালা তৈরিতে কমিটিকে ছয় মাস সময় দিয়েছে সংস্থাটি।
জানা গেছে, ফাইভজি প্রবর্তনের রূপরেখা, সম্ভাব্য তরঙ্গ, তরঙ্গ মূল্য ও বাস্তবায়নের সময়কালসহ অন্যান্য বিষয় যুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা তৈরি করবে ১৩ সদস্যের এ কমিটি। এছাড়া ফাইভজি সেবার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরির দায়িত্বও থাকবে কমিটির ওপর। এসব কার্যক্রম সম্পন্নে কমিটিকে সময় দেয়া হয়েছে আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
বিটিআরসির স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট (এসএম) বিভাগের কমিশনারকে আহ্বায়ক করে গঠন করা কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মহাপরিচালক (এসএম), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার একজন করে প্রতিনিধি, বিটিআরসির পরিচালক (এসএম), সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের লে. কর্নেল থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার প্রতিনিধি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার একজন করে প্রতিনিধি, বিটিআরসির পরিচালক (এলএল), অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) প্রতিনিধি, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) প্রতিনিধি এবং টেলিটকের প্রতিনিধি। বিটিআরসির উপপরিচালক (এসএম) কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ফাইভজি সেবা ২০২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রচলন হতে যাচ্ছে, যা ২০৩০ সাল নাগাদ জনপ্রিয়তা পাবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও নতুন এ প্রযুক্তি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফাইভজিতে সম্ভাব্য ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে ৩ দশমিক ৫ গিগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। বর্তমানে এ ব্যান্ডটিতে দেশের বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (আইএসপি) তরঙ্গ বরাদ্দ রয়েছে। আইএসপিগুলোকে পরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যান্ডের তরঙ্গ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ।
২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। চার অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল থ্রিজির বাণিজ্যিক সেবাদানের লাইসেন্স পায়। থ্রিজির লাইসেন্স, তরঙ্গ বরাদ্দ ও নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বাবদ এখন পর্যন্ত অপারেটরদের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ এর বিপরীতে তারা আয় করেছে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা। তবে ফোরজির আয় পৃথকভাবে হিসাব রাখা হয় বলে জানিয়েছে সেলফোন অপারেটররা।
ফোরজি সেবা চালুতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আবেদন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিটিআরসি। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করে বিটিআরসি। অ্যামটবের তথ্যমতে, শুধু ফোরজি নেটওয়ার্ক প্রস্তুত ও সম্প্রসারণে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে চার সেলফোন অপারেটরের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩০ কোটি ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা (ডলারের বিনিময় হার ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সা হিসাবে)। এর বাইরে তরঙ্গের প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা ও তরঙ্গ বরাদ্দ বাবদ অপারেটরদের ব্যয় হয়েছে আরো প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে চালু করা থ্রিজিতে বিনিয়োগের তুলনায় সামান্যই আয় করতে পেরেছে অপারেটরগুলো। আর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে লাইসেন্স দেয়া ফোরজি প্রযুক্তির জন্য এক বছরে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে ফাইভজি প্রযুক্তি চালুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সেলফোন অপারেটরগুলো বলছে, প্রযুক্তিনির্ভর সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এ ধরনের রোডম্যাপ থাকলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেয়া যায়, তেমনি গ্রাহকসেবা মানোন্নয়নও সম্ভব হয়।
বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে সেলফোন অপারেটরদের সংযোগ সংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ৭ কোটি ৫৩ লাখ, রবি আজিয়াটার ৪ কোটি ৭৯ লাখ, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৪৬ লাখ ও টেলিটকের ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার সংযোগ রয়েছে। দেশে ৯ কোটি ৬২ লাখ ইন্টারনেট সংযোগের মধ্যে সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবার আওতায়ই রয়েছে ৯ কোটির বেশি। এর মধ্যে সেলফোন অপারেটরদের ফোরজি সেবার সংযোগ রয়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সারা বিশ্বেই ফাইভজি নতুন একটি প্রযুক্তি। আগামী দিনের শিল্পে ব্যান্ডউইডথের গতি ও চাহিদার বৃদ্ধি ঘটবে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে ফাইভজি চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, প্রস্তুতি হিসেবে গত বছরের ২৫ জুলাই দেশে ফাইভজির পরীক্ষা চালানো হয়। হুয়াওয়ের প্রযুক্তিগত সহায়তায় পরিচালিত হয় এ পরীক্ষা। এতে সহযোগিতা করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং রবি আজিয়াটা। ফাইভজি ইকোসিস্টেম প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এ পরীক্ষা চালানো হয়।