স্পেনের বার্সেলোনায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে মোবাইল ফোন নির্মাতাদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন ‘মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস (এমডব্লিউসি)-২০২৩’। এ সম্মেলনে বুথ দর্শনার্থীদের নজরদারির অভিযোগ উঠেছে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে। দর্শনার্থীদের মধ্যে যারা হুয়াওয়ের নিরাপত্তা ব্যাজ ফেরত দেননি, তারা এর ফিতার সঙ্গে সংযুক্ত সন্দেহজনক কিছু চিপ খুঁজে পেয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
টেক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের এমডব্লিউসিতে হুয়াওয়ের বুথে আসা দর্শনার্থীদের বুথ ত্যাগের সময় ব্যাজ ফেরত দিতে বলা হয়। তবে দর্শনার্থীদের মধ্যে কিছু লোক ভুলে হুয়াওয়ের এসব ব্যাজ ফেরত দিতে পারেননি। এখানেই বিপত্তির শুরু।
নিউইয়র্ক সিটিভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা লাইট রিডিংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, দর্শনার্থীরা তাদের কাছে থাকা ব্যাজের ওপর ছোট প্লাস্টিকের পাত্রে একটি ইলেকট্রনিক চিপ পেয়েছেন। এ দর্শনার্থীদের মধ্যে নকিয়া করপোরেশনের ইউরোপ অংশের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রোল্ড ওয়ার্নারও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাজের ফিতার সঙ্গে থাকা চিপটি অবস্থান ট্র্যাকার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
বিষয়টি এমডব্লিউসিতে অংশ নেয়া দর্শনার্থীদের অসন্তুষ্ট ও অবাক করেছে। কেননা আগেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তাদের পণ্যে এ ধরনের চিপ ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। রোল্ড ওয়ার্নারের পাশাপাশি অনেকেই টুইট পোস্টে হুয়াওয়ের ট্র্যাকারের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে একজন লিখেছেন, ‘অভিনন্দন! যারা ‘অরেঞ্জ’ অপারেটরটি ব্যবহার করেন। চীন তাদের হুয়াওয়ে নামে চেনে।’
সেলফোন তথ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট ফোন অ্যারেনা জানিয়েছে, হুয়াওয়ে নিম্ন শক্তিসম্পন্ন বিকন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। প্রযুক্তিটি ৭০ মিটার দূরত্ব থেকে মানুষকে ট্র্যাক করতে পারে। তবে হুয়াওয়ে জানিয়েছে, দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা ব্যাজের সঙ্গে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে।
হুয়াওয়ে কর্তৃপক্ষের বিবৃতি অনুযায়ী, হুয়াওয়ের প্রদর্শনীর প্রবেশপথে এর নিরাপত্তা কার্ড ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। এর মাধ্যমে এর স্টলে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় এবং প্রদর্শনী এলাকার মধ্যে কার্ডধারীদের অবস্থানের সময় এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাজটিতে আরএফআইডি ও ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, হুয়াওয়ের নিরাপত্তা ব্যাজটি শুধু বুথে ব্যবহার হয়। দর্শনার্থীরা বেরিয়ে আসার পর তা ফেরত নেয়া হয়। বার্সেলোনার এমডব্লিউসিতে আগত দর্শনার্থীদের অবস্থান নজরদারির কোনো উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন হুয়াওয়ের নেই।
প্রযুক্তি সংবাদমাধ্যম গিজচায়না জানিয়েছে, স্বচ্ছতার অভাবের জন্য সমালোচিত হয়েছে হুয়াওয়ে। এ পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানকে আরো নেতিবাচক করবে। কেননা এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে সফটওয়্যারে গোপন চিপ ইনস্টল এবং ব্যবহারকারীর তথ্য চীনে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার কারণে মার্কিন কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আরো নিষেধাজ্ঞা আসছে
চীনা প্রযুক্তি জায়ান্টটির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ পুরনো। তবে শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বেশ কয়েকটি দেশ ফাইভজি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
জার্মানভিত্তিক সংবাদপত্র জেইট অনলাইনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্যের নেটওয়ার্ক অপারেটরদের সব ধরনের হুয়াওয়ে কিট অপসারণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া জার্মান সরকার টেলিকম অপারেটরদের তাদের নেটওয়ার্কগুলোয় হুয়াওয়ে ও জেডটিই কোম্পানির কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে হুয়াওয়ের প্রতি ট্রাম্প যুগের বিধিনিষেধ আরো কঠোর করার কথা ভাবছে বাইডেন প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞাটি চিপ সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক এনভিডিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। সর্বশেষ মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্সিং রুলসের সংশোধনী খসড়ায় এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় চিপ সরঞ্জামে চীনের অ্যাক্সেসের প্রতি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ওই নিষেধাজ্ঞা চীনের উন্নত নজরদারিসংক্রান্ত প্রযুক্তি ও অস্ত্র তৈরি বাধাগ্রস্ত করবে। একই সময়ে হুয়াওয়ের সাম্প্রতিক কার্যক্রম ও অভিযোগগুলো চীনা প্রযুক্তি খাতকে চাপের মধ্যে ফেলবে।