তড়িঘড়ি করে আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজে হুয়াওয়েকে নিয়োগের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হয়, বাংলাদেশে নাকি সরকারি ফাইল শামুকের গতিতে আগায়। আর এর ফলে যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে সময় লেগে যায় অনেক বেশি।
তবে যে গতিতে ফাইলের কাজ এগিয়ে চীনের টেলিযোগাযোগ (টেলিকম) সংস্থা হুয়াওয়েকে ৫জি নেটওয়ার্ক অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়েছে, তাকে অবিশ্বাস্যই বলা চলে।
জানা গেছে, দরপত্র উন্মুক্তকরণ নোটিশ দেওয়ার দিন থেকে থেকে শুরু করে হুয়াওয়ের কাজ পাওয়ার দিনটি পর্যন্ত সব ধরনের সরকারি কাজ নজিরবিহীন দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। আর এই দ্রুতগতিতে কাজ করতে গিয়ে ৫জি প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) লঙ্ঘন করেছে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিকাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ক্রয় সংক্রান্ত নীতিমালা।
তড়িঘড়ি করে আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজে হুয়াওয়েকে নিয়োগের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে যেখানে বেশিরভাগ উন্নত দেশে ৫জি নেটওয়ার্ক সরবরাহের কাজ পেতে বাধার মুখে পড়েছে হুয়াওয়ে।
সিপিটিইউর সাবেক মহাপরিচালক একেএম ফজলুল করিম বলেন, ‘এটা নজিরবিহীন এবং অসম্ভবও বটে—সরকারের উচিত বিষয়টি তদন্ত করা।’
দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা ৫জি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিটিসিএলকে ৪৬৩ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি অপটিকাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বসানোর দায়িত্ব দেয়।
বিটিসিএল গত বছরের ডিসেম্বরে ৫জি সেবার জন্য দরপত্র চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিলে এতে সাড়া দেয় হুয়াওয়ে, জেডটিই ও নোকিয়া। তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই কারিগরি নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এটাই এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রকল্পের কারিগরি চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে না পারা সত্ত্বেও এই সুযোগ পায়।
নথি অনুযায়ী, বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী এই কারিগরি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সই করেননি। তিনি নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করার দাবি জানান। এ কারণে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
অক্টোবরে তাকে পদাবনতি দিয়ে টেলিযোগাযোগ বিভাগে মহাব্যবস্থাপক পদ দেওয়া হয়। এরপর ৭ নভেম্বর তাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। পরের দিন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে দুটি উদ্যোগই আদালতে স্থগিত হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে, ৬ নভেম্বর প্রকল্প পরিচালক মো. মনজির আহম্মেদ টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের ৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় তার কার্যালয়ে দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। অন্তত সাত দিনের অগ্রিম নোটিশ দেওয়ার বিধি থাকলেও এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালকের কার্যালয়ে অনুমোদিত প্রতিনিধি পাঠাতে ৪৮ ঘণ্টারও কম সময় দেওয়া হয়।
এই চিঠি হাতে পাওয়ার একদিন পর চীনের টেলিকম প্রতিষ্ঠান জেডটিই মনজির আহম্মেদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়ার অনিয়মের বিষয়ে তাদের আপত্তি জানায়।
চিঠিতে বলা হয়, ‘আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্তকরণ বৈঠকে যোগ দেওয়ার অধিকার সমুন্নত রাখতে আমরা অনুরোধ করছি, টেন্ডার নথিতে উল্লেখিত সিপিটিইউর স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার নথির আইটিটি ধারা ৫৩ দশমিক এক মতে, ন্যূনতম সাত দিনের নোটিশ দেওয়া হোক। তা না হলে টেন্ডার নথিতে উল্লেখ করা শর্তের এবং (সম্ভাব্য সরবরাহকারী হিসেবে) আমাদের অধিকার লঙ্ঘন হবে।’
জেডটিই জানায়, তাদের প্রতিনিধি বাংলাদেশে নেই এবং দুই দিনেরও কম সময়ে নোটিশে এই কর্মকর্তাকে হাজির করা সম্ভব নয়। সংস্থাটি বিটিসিএলকে অনুরোধ করে, নির্ধারিত দিনটিতে তাদের অনুমোদিত প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়া আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু না করতে।
দরপত্র জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথোপযুক্ত সময় না দিয়ে বিটিসিএল তাদের নিজেদের টেন্ডার নথিতে উল্লেখ করা নীতির বিরুদ্ধে গেছে বলে মত প্রকাশ করেন সিপিটিইউর সাবেক মহাপরিচালক ফজলুল করিম।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা হুট করে দুই দিনেরও কম সময়ের নোটিশে আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্তকরণ বৈঠকে যোগ দিতে পারেন না।’
এখানেই টেন্ডার প্রক্রিয়ার অনিয়ম থেমে থাকেনি। হুয়াওয়ে সবচেয়ে কম খরচে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব জমা দেয়, যার পরিমাণ ৩২৬ কোটি টাকা। এই দর অনুযায়ী কাজ দেওয়ার বিষয়টি হুয়াওয়েকে জানানো হয় ‘নজিরবিহীন’ দ্রুততার সঙ্গে।
মাত্র দুই কর্মদিবসে, ছুটির দিনসহ ধরলে মোট চার দিনে বিটিসিএলের বোর্ড সব ধরনের যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ শেষে ১২ নভেম্বর চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়।
টেন্ডার নথিতে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর আগেই কমিটিকে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ের ব্যাখ্যা নিতে হবে, গাণিতিক ত্রুটি সংশোধন করতে হবে এবং সমস্ত দরদাতাদের দামকে একক মুদ্রায় রূপান্তর করতে হবে। তারপরে তাদের দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী প্রতিটি প্রস্তাবের মূল্যায়ন করতে হবে এবং সর্বনিম্ন মূল্যে কোন সংস্থাটি (যারা একইসঙ্গে সব শর্ত মানছে) প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে। পরিশেষে, দরপত্রের হালনাগাদ কারিগরি ও আর্থিক যোগ্যতা ও দরপত্রে উল্লেখিত চাহিদার বিপরীতে পরবর্তী মূল্যায়ন প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হবে।
ফজলুল করিমের মতে, আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘মাত্র দুই কার্যদিবসের মধ্যে সব নথি মূল্যায়ন করা অসম্ভব। কারণ নথিগুলো অবশ্যই ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে।’
পরদিন ১৩ নভেম্বর বিটিসিএলের ২১৬তম বোর্ড সভায় হুয়াওয়ের আর্থিক প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর পরের দিন হুয়াওয়েকে কাজের আদেশ পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জরুরিভিত্তিতে সভা আহ্বান না করা হলে সভার আলোচনাসূচি (এজেন্ডা) কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা আগে বোর্ড সদস্যদের কাছে পাঠাতে হবে। আর ক্রয় আদেশ থাকলে কী অনুমোদন দিতে যাচ্ছেন তা বোঝার জন্য বোর্ড সদস্যদের ৭২ ঘণ্টা আগে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক বোর্ড সদস্য জানান, তিনি ৯ নভেম্বর বোর্ডের বৈঠকের আমন্ত্রণ পেলেও এতে বিটিসিএলের কোম্পানি সচিবের ৮ নভেম্বরের সই দেওয়া ছিল।
‘আমি বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের ২১৬তম বৈঠকের আমন্ত্রণের সঙ্গে কোনো এজেন্ডাও পাইনি’, বলেন তিনি।
বিটিসিএলের নানা টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন এক সাবেক কর্মকর্তা জানান, নিরীক্ষা কমিটির কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার এক দিনের মাথায় কোনো দরপত্রের চূড়ান্ত প্রতিবেদন বোর্ডের কাছে উপস্থাপন করার বিষয়টি অত্যন্ত অস্বাভাবিক।
বৈঠকের মিনিটস তৈরি করতে কোম্পানি সচিব অন্তত কয়েকদিন সময় নেন। এই মিনিটস ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো হয় এবং সবশেষে এর সংশোধন ও পরিমার্জনের পর চেয়ারম্যান এতে সই করেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম তিন থেকে চার দিন সময় প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খুবই বিস্ময়কর যে এটা বোর্ডে পাস হয়েছে এবং বৈঠকের পরের দিনই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে আগে থেকেই নির্ধারণ করা একটি প্রতিষ্ঠানকে সাজানো দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের কাজ দেওয়া হলো।’