ইন্টারনেট এখন কোনো বিলাসিতা নয়, বিশ্বের উন্মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশপথের চাবিকাঠি। এর গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী ও অপরিসীম। ইন্টারনেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর সব কর্মকাণ্ড। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক বেশি ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর। অনলাইনে পাঠদান, এমনকি টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণেও অনলাইন-নির্ভরতা বেড়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকৃত মানবসম্পদ তৈরিতে ইন্টারনেট এখন একটি মৌলিক অনুষঙ্গ। ফলে দেশে ক্রমেই ইন্টারনেট গ্রাহক বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ কোটি ৯৪ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল দেশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১২ কোটি ৬২ লাখ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ কোটি ৯ লাখ।
এখন দরকার জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু অপারেটরগুলোর অতিমাত্রায় মুনাফা লাভের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুসোরে, অপারেটরগুলোর মোবাইল ইন্টারনেট প্রতি গিগায় প্রাথমিক গড় ব্যয় প্রায় ৪ টাকা, অথচ বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩৫ টাকায়। এ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশের সেলফোন অপারেটরগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিমাত্রায় মুনাফা লাভ করছে। প্রতি গিগাবাইট ডাটায় ব্যয়ের সঙ্গে সেলফোন অপারেটরদের বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান অনেক বেশি, যা মোটেই কাম্য নয়। জনগণকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সাশ্রয়ী মূলে দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এখন শক্ত পদক্ষেপ দরকার। প্রয়োজনে এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে।
দেশে ডাটার ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) অপারেটরদের দেয়া ব্রডব্যান্ড সংযোগেরও গ্রাহক বেড়েছে। সিংহভাগ গ্রাহকই সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। ফোরজি প্রযুক্তি অপারেটরদের ডাটাভিত্তিক সেবা আরো সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দিয়েছে। এটিকে কাজে লাগিয়ে অপারেটররা ব্যবসা করলেও সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাহক। অনেকের অভিযোগ, উচ্চ গতি ও উন্নত সেবার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে সর্বক্ষণ। তাদের মতে, মোবাইল অপারেটরগুলো প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে তাদের বিভিন্ন প্যাকেজ ও সেবার বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে। কোম্পানিগুলো যদি বিজ্ঞাপন খাতসহ অপ্রয়োজনীয় অর্থ খরচ কমিয়ে আনে তাহলে গ্রাহককে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়া নেটওয়ার্কের বেহাল, কল ড্রপসহ গ্রাহক হয়রানির কোনো শেষ নেই। অপারেটরদের শহরকেন্দ্রিক মনোযোগ বেশি। কিন্তু গ্রামে তাদের মনোযোগ কম। ফলে গ্রাম এলাকায় ফোরজি সেবা পর্যাপ্ত নয়।
মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের ব্যবস্থাটি অনুসরণ করা যেতে পারে। দেশ দুটি মাথাপিছু পর্যাপ্ত স্পেকট্রাম বরাদ্দ ও নিয়মিত সেবার মান পর্যবেক্ষণ করে। সময়ে সময়ে অপারেটদের পরামর্শ গ্রহণ ও তাদের ওপর বিভিন্ন নির্দেশনার মাধ্যমে সেবার মান বাড়িয়ে চলেছে। এর সুবিধাও দেশগুলো পাচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকেও তারা এগিয়ে। সেবার মান উন্নয়নে তারা নির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট সেবা উন্নয়নের গুরুত্ব বাড়ছে। ই-কমার্স থেকে শুরু করে অনেক কাজেই নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি দেশই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবার পাশাপাশি মানোন্নয়নের চেষ্টা করছে। বিশ্বের অন্যান্য এলাকার মতো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যেও ইন্টারনেট সেবার মানোন্নয়নের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বছরের হিসাবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর ইন্টারনেট সেবার গড় গতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রাহককে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার উপায় কী? উপায় একটাই—নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো গতিশীল, উদ্যোগী ও উদ্যমী ভূমিকা পালন করতে হবে। সব অপারেটর গ্রাহককে সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা দিচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত করার দায় কিন্তু এ নিয়ন্ত্রক সংস্থারই। মোবাইল অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় যে ব্যয় হয় তার বাইরেও বড় ধরনের ব্যয় রয়েছে। এসব ব্যয়ের একটি বড় অংশ সরকারকে দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, সিম কার্ডপ্রতি ৩০০ টাকা কর, ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর, টেলিকম পণ্য আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক ইত্যাদি। এছাড়া স্পেকট্রাম বরাদ্দ সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস। বিটিআরসির রেগুলেটরি ফি, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলেও অর্থ দিতে হয় সেলফোন অপারেটরদের। সরকারের উচিত গ্রাহকবান্ধব সিদ্ধান্ত নেয়া।
বাংলাদেশে সেলফোনের বিপ্লব সম্ভব হয়েছে মূলত উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার কারণে। ফলে এ খাতে বিপুল পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ ও গ্রাহক বেড়েছে। সর্বোপরি সেলফোন সেবা সর্বসাধারণের যোগাযোগের সহজতর মাধ্যম হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে এবং এ সেবার মাধ্যমে ব্যাপক পরিসরে অন্যান্য সেবা, যেমন টাকা লেনদেন, ই-কমার্স, ই-কৃষি, অ্যাপসভিত্তিক নানা ধরনের সেবার মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতির ভিত তৈরি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের যোগাযোগের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ, সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে ওঠা ও প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য পরিবর্তন—সব মিলিয়ে এ শিল্পের প্রসার দ্রুত ঘটছে। এখন দরকার এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানসম্পন্ন সেবার পাশাপাশি সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেয়া। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও মোবাইল অপারেটররা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে বলে প্রত্যাশা।