সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের চাপে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ওরাকল’কে ১৮ মিলিয়ন ডলারের কাজ সরাসরি টেন্ডারে দেওয়া হয়েছে। ১১৫ টাকা হিসেবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০৭ কোটি টাকা মূল্যের কাজটির বিনিময়ে ৩ বছরের জন্য ক্লাউড সেবা দেবে ওরাকল। বিদ্যুৎ খাতের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের লাইন্সেন্স দেওয়ার মতো ঘটনা ওরাকল নিয়ে ঘটিয়েছেন পলক। অভিযোগ আছে, এজন্য ৩০ শতাংশ কমিশন নিয়েছিলেন পলক, যার ভাগ পেয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার সাবেক আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। আর্থিক লেনদেনে সহকারী হিসেবে পলকের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইকরামুল হকের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।
আর সংশ্লিষ্টরা বলছে, ক্লাউড সেবার নামে ওরাকলকে এই কাজ পাইয়ে দেওয়ার নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড তারিক এম বরকতউল্লাহ। অন্যদিকে দেশের তথ্য বিদেশে রেখে ৪ লাখ ২০ হাজার ডলার খরচ করা পলক আইন করছিলেন দেশের তথ্য দেশেই রাখার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের দিকে সরকারি সংস্থাগুলোর উপাত্ত সংরক্ষণে সরকারের একটি কেন্দ্রীয় ক্লাউড সেবা ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর আগে সংস্থাগুলো নিজেদের মতো অর্থ খরচ করে ক্লাউড প্রযুক্তি সেবা নিতো। সেসময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ কেন্দ্রীয়ভাবে ক্লাউড ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা ছিল। প্রাথমিক উদ্দেশ ছিল ক্লাউড ব্যবস্থা তৈরি করে সেই প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর কাছে ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়। এমন একটি ক্লাউড সেবার প্রস্তাব সেসময় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিস) অধীন জাতীয় ডাটা সেন্টারকে (এনডিসি) দেয় ওরাকল। তবে বিসিসি’র তৎকালীন পরিচালক তারিক এম বরকতউল্লাহ সেই প্রস্তাব ঘুরিয়ে দেন বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) দিকে। সূত্র বলছে, পলককে দিয়ে বিডিসিসিএল’এ ওরাকলের ক্লাউড ব্যবস্থা স্থাপনের মূল ‘মাস্টারমাইন্ড’ এই তারিক বরকতউল্লাহ। প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদনে সদস্যরা এই ক্লাউড সেবার বিরুদ্ধে মত দেন। শুধু তারিক বরকতউল্লাহ কোন মতামত না নেওয়ার মাধ্যমে সেই প্রতিবেদনে এককভাবে ভেটো দেন।
পরবর্তীতে পলকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ওরাকলের সাথে বিডিসিসিএল ‘ডেডিকেটেড রিজিওনাল ক্লাউড’ স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই ক্লাউড থেকে ৩ বছরের সেবা নিতে মোট ১৮ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বিডিসিসিএল এর। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বছরে যথাক্রমে ৩, ৬ এবং ৯ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে বিডিসিসিএল। ওরাকলের সাথে বিডিসিসিএলের অসম চুক্তির ধরণ বোঝা যায় কুইক রেন্টালের সাথে তুলনায়।
বিডিসিসিএল এর তৎকালীন একটি সূত্র বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, কুইক রেন্টালের নামে সরকারি পাওয়ার প্ল্যান্টের উন্নয়ন না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়েছে। ক্লাউড অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নিজস্ব ডাটা সেন্টারের উন্নয়ন না করে সেটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে অর্থ দিতে হয়। ওরাকলের ক্ষেত্রেও তাই। তাদের ক্যাপাসিটি ব্যবহার না করলেও পুরো অর্থই দিতে হবে। এক কথায়, পলক কুইক রেন্টাল মডেল এখানে কপি-পেস্ট করেছেন। এই চুক্তির আরেকটি অসম দিক হচ্ছে, ওরাকল এবং বিডিসিসিএল এর মধ্যে কোন জটিলতা দেখা দিলে আর এজন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হলে, বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যেমন বাংলাদেশকে নিউইয়র্কে মামলা করতে হয়েছে, এখানেও বিষয়টি তেমন। অর্থ্যাত বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে বিষয়টির মীমাংসা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
দীর্ঘ অনুসন্ধান বলছে, কোনরকম প্রতিযোগিতামূলক অথবা আন্তর্জাতিক টেন্ডার ছাড়াই ‘ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম)’ এ ওরাকলকে কাজটি দিয়েছেন পলক। তবে ৪৯ কোটি টাকা মূল্যের বেশি দরপত্র একনেকে পাশ করিয়ে নেওয়ার নিয়মও ওরাকলের ক্ষেত্রে কৌশলে এড়িয়েছেন পলক। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিডিসিসিএল সরাসরি ক্রয় করতে পারে, এমন চিঠি অর্থ বিভাগ থেকে সেসময় ‘ম্যানেজ’ করেছিলেন তিনি। তবুও বিডিসিসিএল এর পরিচালনা পর্ষদের অন্তত ৩ সদস্য এই প্রস্তাবের মৌখিত বিরোধিতা করেছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সূত্র। সেসময়কার পর্ষদের এক সদস্য পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, প্রতিমন্ত্রী পলক বোর্ড সভায় উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন যে ওরাকলের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে দেরি হচ্ছিল কেন। কয়েকজন মৌখিকভাবে ওরাকল ক্লাউডের বিরোধিতা করি। লিখিতভাবে করতে পারিনি। সেসময় পলকের বিরুদ্ধে যাওয়ার মত বিষয় ভাবাও যেতো না। সবশেষে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর ওরাকলের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিডিসিসিএল। চুক্তি স্বাক্ষরকালে সংশ্লিষ্টদের সাথে ওরাকল বাংলাদেশের প্রধান রুবাবা দৌলা, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলক এবং তারিক বরকতউল্লাহও ছিলেন। অবশ্য গত মে মাসে অর্থাৎ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় আড়াই বছর পর এই ক্লাউড সেবা চালু করতে সক্ষম হয় ওরাকল। গত ৬ মে সালমান এফ রহমানের উপস্থিতিতে পাঁচ তারকা হোটেলে বেশ জাকজমক আয়োজনে এর উদ্বোধন করা হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর আর কার্যক্রম শুরুর মাঝের সময় নিয়ে পাওয়া যায় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। চুক্তি স্বাক্ষর পরবর্তী সময় থেকেই ওরাকলের সিঙ্গাপুর ক্লাউডে উপাত্ত সংরক্ষণ শুরু করে বিডিসিসিএল। এক বছরের সেবার জন্য ওরাকলকে আরও ৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা ৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা (ডলারের দাম ১১৫ টাকা হিসেবে) দিয়েছে বিডিসিসিএল। এর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভিন্ন কোন টেন্ডার বা চুক্তি না করে, পূর্বের চুক্তি মূলেই ওরাকল সিঙ্গাপুর থেকে সেবা নেওয়ার নামে ঐ অর্থ পরিশোধ করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, পলক যখন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল ডাটা সিঙ্গাপুরে রাখছিলেন, তখনই ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন,২০২২’ নামে একটি আইনের খসড়াও করছিল তার অধীনস্ত আইসিটি বিভাগ। এই খসড়ার অন্যতম বিষয় ছিল বাংলাদেশে উৎপন্ন ডিজিটাল উপাত্ত বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যেই সংরক্ষণ করতে হবে। অর্থ্যাত একদিকে তথ্য স্থানীয়করণের আইন তৈরি আর অন্যদিকে নিজেই তথ্য দেশের বাইরে পাঠাচ্ছিলেন পলক। এই কার্যক্রমগুলোর সাক্ষী এমন একটি সূত্র জানিয়েছে, ওরাকলের বাংলাদেশে ক্লাউড স্থাপন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী। সিঙ্গাপুর থেকে উপাত্ত দেশে ফিরিয়ে আনলেই উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাস করতেন তিনি। তবে ওরাকলের যন্ত্রাংশ আমদানি বিষয়ক এক জটিলতায় বিষয়টি দীর্ঘায়িত হয়।
এই যন্ত্র আমদানিতেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন পলক। ওরাকলের ক্লাউড স্থাপন করবে গাজীপুরের হাইটেক পার্কে অবস্থিত বিডিসিসিএল এর ডাটা সেন্টারে। নিয়ম অনুযায়ী, হাইটেক পার্কের বিনিয়োগকারীরা বিনাশুল্কে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারে। পলকের পরামর্শে ওরাকল কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে বিনাশুল্কে ক্লাউড যন্ত্রাংশ খালাসের চেষ্টা করে। তবে বিষয়টি ধরা পড়ায় রাজস্ব বিভাগের আওতাধীন কাস্টমস যন্ত্রাংশগুলোর খালাস আটকে দেয়। এই ঘটনার কারণেই সেসময়কার রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় পলকের। বিষয়টি নিয়ে জয়ের করা সুপারিশও আবু হেনা রাখেননি বলে জানা যায়। ফলে মোটা অঙ্কের রাজস্ব দিয়েই যন্ত্রাংশ খালাস করে ওরাকল। এজন্য পলক নিজের কমিশনে কিছুটা ছাড় দিয়েছিলেন বলেও বিডিসিসিএলে প্রচলিত রয়েছে। আইসিটি বিভাগের একটি সূত্র পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, রেডিংটন ডিস্ট্রিবিউশন নামক তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ কমিশন ছিল পলকের। এই অর্থ জয়ের সাথে ভাগাভাগি করেছেন তিনি। লস এঞ্জেলেসে অবস্থানরত ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুবেলের মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করতেন জয়। আর পলকের পক্ষে এসব লেনদেন দেখভাল করতেন তার একসময়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইকরামুল হক। বিশ্বস্ততার পুরস্কারস্বরূপ, ১৬ হাজার টাকার বেতন স্কেলের ইকরামকে সরাসরি ৫০ হাজার টাকা বেতন স্কেলে বিডিসিসিএল এর ব্যবস্থাপক (লজিস্টিক্স) পদে বসান পলক। উদ্দেশ্য ছিল আস্থাভাজন ইকরামের মাধ্যমে বিডিসিসিএল আর ওরাকলের মধ্যেকার লেনদেন থেকে নিজের শেয়ার বুঝে নিতে নিজের লোককে বসানো।
ডাটা সেন্টার এবং ক্লাউড প্রযুক্তিতে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, যে অর্থ ওরাকলে খরচ করা হয়েছে, সেই অর্থে নিজের ক্লাউড তৈরি করা যেতো। স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ লোকবল না থাকলে বিদেশ থেকে আনা যেতো অথবা এখানকার মানবসম্পদকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো যেতো। এতে একটু সময় লাগলেও, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের লাভ হতো। যতটুকু জানি, ওরাকলের এই ক্লাউড প্রযুক্তি অনেক সরকারি দপ্তর ব্যবহারও করছে না কারণ তাদের কাছে বিষয়টি জটিল। চেষ্টা করা হচ্ছে তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করার কিন্তু সেখানেও সরকারি কর্মকর্তাদের আগ্রহ কম। ফলে এই ক্লাউডের সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহৃতই থাকে কিনা, এবং আয় করে ওরাকলের বিল পরিশোধ করা যায় কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।