দেশে নেই দেশের সরকারি ডেটা-নথি। এক ‘অদৃশ্য কারণে’ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এসব ডেটা দেশের বাইরে। আর এটি ঘটানো হয়েছে বেশ গোপনীয়তার সঙ্গেই। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দেশের জাতীয় টায়ার ফোর ডেটা সেন্টারে কী এমন ঘটল বা ঘটানো হলো যে, রাষ্ট্রীয় এমন ডেটা বিদেশী কোম্পানি ওরাকলকে ডেকে এনে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিতে হলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো রকম প্রতিযোগিতা ছাড়াই জাতীয় ডেটা সেন্টারের জন্য ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ওরাকলকে ক্লাউড সেবার দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে দেওয়া এই কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা এক কোটি ৮০ লাখ ডলার। সেই সময়ের দর অনুযায়ী, ২০৭ কোটি টাকার বিনিময়ে তিন বছর ক্লাউড সেবা দেওয়ার কথা ওরাকলের।
তবে রহস্যজনক কারণে চুক্তি স্বাক্ষরের আড়াই বছর পর ক্লাউড সেবা চালু করে ওরাকল। বাছবিচার ছাড়াই ভিনদেশী প্রতিষ্ঠানকে দেশের তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের। একইসঙ্গে পলকের ঝলকে বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার হয়েছিল দুর্নীতির আখড়া।
জানা যায়, ২০২০ সালের দিকে সরকারি সংস্থাগুলোর উপাত্ত সংরক্ষণে সরকারের একটি কেন্দ্রীয় ক্লাউড সেবা ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর আগে সংস্থাগুলো নিজেদের মতো অর্থ খরচ করে ক্লাউড সেবা নিত। সেই সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ কেন্দ্রীয়ভাবে ক্লাউড ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেয়। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ক্লাউড ব্যবস্থা তৈরি করে সরকারি সংস্থাগুলোকে ভাড়ায় দিয়ে অর্থ উপার্জন এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়।
এমন একটি ক্লাউড সেবার প্রস্তাব সে সময় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীন জাতীয় ডেটা সেন্টারকে (এনডিসি) দেয় ওরাকল। তবে বিসিসির তৎকালীন পরিচালক তারিক এম বরকতউল্লাহ সেই প্রস্তাব ঘুরিয়ে দেন বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) দিকে।
সূত্র বলছে, পলককে প্রভাবিত করে ডেটা সেন্টারে ওরাকলের ক্লাউড ব্যবস্থা স্থাপনের মূল ‘মাস্টারমাইন্ড’ এই তারিক বরকতউল্লাহ। প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সদস্যরা এই ক্লাউড সেবার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। শুধু তারিক বরকতউল্লাহ ওই কমিটির প্রতিবেদনে এককভাবে ভেটো দেন। পরবর্তী সময়ে পলকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ওরাকলের সঙ্গে বিডিসিসিএল ‘ডেডিকেটেড রিজিওনাল ক্লাউড’ স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হয়।
এই ক্লাউড থেকে তিন বছরের সেবা নিতে মোট ব্যয় ধরা হয় এক কোটি ৮০ লাখ ডলার। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বছরে যথাক্রমে ৩০, ৬০ এবং ৯০ লাখ ডলার পরিশোধ করার কথা বিডিসিসিএলের। অবশ্য চুক্তির এক কোটি ৮০ লাখ ডলারের কোনো অংশ এখনো ওরাকলকে দিতে হয়নি। বাংলাদেশী মুদ্রায় সেই সময়ের দর অনুযায়ী ২০৭ কোটি টাকা। তবে আগামীতে এই অর্থ পরিশোধ হলে পলক সিন্ডিকেটের কমিশন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো রকম প্রতিযোগিতামূলক অথবা আন্তর্জাতিক টেন্ডার ছাড়াই ‘ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে (ডিপিএম)’ ওরাকলকে কাজটি দিয়েছেন পলক। তবে ৪৯ কোটি টাকা মূল্যের বেশি দরপত্র একনেকে পাস করিয়ে নেওয়ার নিয়মও ওরাকলের ক্ষেত্রে কৌশলে এড়িয়েছেন পলক। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিডিসিসিএলের সরাসরি ক্রয় ক্ষমতার সুযোগ নিয়েছেন তিনি।
একটি সূত্রের তথ্য মতে, ক্লাউড হয়ত প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এমন সেবা দেয় সে রকম আরও প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা যেত। সেই সময়কার পর্ষদের আরেক সদস্য বলেন, প্রতিমন্ত্রী পলক বোর্ডসভায় উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন যে, ওরাকলের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে দেরি হচ্ছিল কেন। সবশেষে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর ওরাকলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিডিসিসিএল।
অবশ্য গত মে মাসে অর্থাৎ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় আড়াই বছর পর এই ক্লাউড চালু করে ওরাকল। গত ৬ মে সালমান এফ রহমানের উপস্থিতিতে পাঁচতারকা হোটেলে বেশ জাঁকজমকভাবে এর উদ্বোধন হয়। চুক্তির পর থেকেই ওরাকলের সিঙ্গাপুর ক্লাউডে উপাত্ত সংরক্ষণ শুরু করে বিডিসিসিএল।