ঈদের ছুটির পর প্রথম কর্ম দিবস, ১৫ জুন বসুন্ধরা আবাসিকের প্রবেশ মুখে গ্রামীণফোন হাউজের সামনে ফের জড় হয়েছিলেন গ্রামীণ ফোনের সাবেক কর্মীরা। তবে এদিনের সমাবেশ ছিলো আগের চেয়ে ভিন্ন। কালো পোশাকে পড়ে মাথায় কালো ব্যান্ড বেঁধে হাতে ধরে ছিলেন কালো ব্যানারে লেখা- “আমরা শোকাহত”। তাদের সমাবেশ ছিলো অকাল প্রয়াত সাবেক সহকর্মী রাজীব মাহমুদের। উপস্থিত সবার হাতে ছিলো তার ছবি ও ফেসবুকে লেখা বিভিন্ন নোট সমৃদ্ধ ফেস্টুন।
এর একটিতে লেখা ছিলো – “আমার পাওনা টাকা দে – ভাত না ওষুধ কিনে খাব!”
“কিন্তু গ্রামীণফোন তাঁর এই প্রার্থনাও উপেক্ষা করেছে” উল্লেখ করে রাজীবকে গ্রামীণফোন হত্যা করেছে মর্মে ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন সমাবেশে উপস্থিত বক্তারা। প্রাক্তন গ্রামীণফোন অর্ধ শতাধিক কর্মী জড়ো হয়েছিলেন এই শোকাবহ প্রতিবাদী সমাবেশে। এই প্রতীকী শবযাত্রায় অংশ নিয়ে তারা গ্রামীণফোনের বর্তমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষের দিতে আঙুল তুলে তারা বলেছেন- “রাজীব মাহমুদের মৃত্যু নয় — এটি একটি নির্মম কর্পোরেট হত্যাকাণ্ড”; “গ্রামীণফোন এখন আর একটি নাম নয় — এটি একটি ঘৃণার প্রতীক”।
গ্রামীণ ফোনের সাবেক কর্মী মনোয়ার পারভেজ , মোবাশ্বের আহসান ও আদিবা জেরিন প্রয়াত রাজীবের জীবনের সংগ্রাম, দুঃখ ও মৃত্যু নিয়ে আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। সহকর্মী সাদিয়া আফরিন আবৃত্তি করেন টরন্টো থেকে রাজিব স্মরণে সাবেক গ্রামীণ ফোন কর্মী মাকসুদা খানম রচিত কবিতা। এই কবিতা পাঠের সময় থমকে দাঁড়িয়েছেন পথচারীরাও। দীর্ঘ ৫ মিনিট ব্যাপী আবৃত্তি শুনে অনেকে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
একজন সহযোদ্ধার অসমাপ্ত গল্প শিরোনামের কবিতায় উল্লেখ করা হয়, মুখে ব্যাথা, শরীরে যন্ত্রণা নিয়েও রাজীব ছিলো অতন্দ্র প্রহরী, হাসপাতালের বেডে শুয়েও আঙুলে ব্যাথা নিয়েই গিটারে ন্যায়ের সুর তুলেছে। কিন্তু ওরা (গ্রামীণ ফোন কর্তৃপক্ষ) সুর, গান, কবিতা বোঝে না। ক্ষমতা আর করপোরেট পলিটিক্স বুঝতে হয়।
গ্রামীণ ফোনে কর্তৃপক্ষকে উল্লেখ করে কবিতায় বলা হয়- “তুমি যখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছিলে, তখন কাঁচের বোতলের ভূতেরা হয়তো বলছিলো মনে মনে ওই ব্যাটা মরে না কেন? আজ ওরা খুশী, ওদের হাতের একটা দাবার গুটি খসে পড়েছে। আজ কেউ বিদ্রুপ করে গাইবে না সত্যের গান।
কবিতায়-প্রতিবাদে বক্তারা জানান, সাবেক একজন কর্মীকে বকেয়া টাকা না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার পরও তারা জন্য একটু শোক প্রকাশ পর্যন্ত করেনি গ্রামীণ ফোন।
ক্ষোভের ভাষায় উঠে আসে- “একটি বিশেষ গ্রুপে তোমার মৃত্যু সংবাদ অবমানিত, অদৃশ্য। ওখানে ইন্না লিল্লাহ দিতে টাকা লাগে। তুমি তো মানুষ। তাদের ক্লায়েন্ট না। ইউনিয়ন যেমন বুঝে কাফনে সরিয়ে মুখ দেখে ইমপ্লয়ি আইডি মিলিয়ে তবেই দেয় কন্ডোলেন্স ম্যাসেজ।”
সমাবেশে অংশ নেয়া বক্তারা মনে করেন, রাজীব মাহমুদের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত কর্পোরেট হত্যাকাণ্ড — যার জন্য সরাসরি দায়ী গ্রামীণফোন ম্যানেজমেন্ট। ১৫ বছর ধরে তাঁর প্রাপ্য ৫% পাওনা আটকে রেখে তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
শেষ মুহূর্তেও তিনি আর্তনাদ করেছিলেন, “আমার টাকা দাও — ভাত না, ওষুধ কিনে খেতে চাই। কিন্তু গ্রামীণফোন তার এই প্রার্থনাও উপেক্ষা করেছে।”
বক্তব্যে আদিবা জেরিন বলেন, গ্রামীণফোন যে আবেগ বিক্রি করে তা সত্যি না। সাবেক কর্মীদের প্রাপ্য আদায়ে ৬ মাস ধরে তারা কোনো খোঁজ নেয়নি। তাদের উচিত বৈঠক করে এর সমাধান করা। তা না হলে আরো কঠোর আন্দোলন হবে।
সমাবেশে গ্রামীণফোন ৫% বিলম্ব বকেয়া আদায় ঐক্য পরিষদ আহ্বায়ক আবু সাদাত মোঃ শোয়েব বলেন, এটি শুধুমাত্র একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি নায়। এটি মানবতার প্রতি একটি চিৎকার, ন্যায়বিচারের জন্য আহ্বান, এবং রাজীব মাহমুদের মৃত্যুর জন্য জবাবদিহি চাওয়া। তাই আমরা সংবাদকর্মী, সুশীল সমাজ ও বিবেকবান মানুষের প্রতি আহ্বান জানাই — সত্য প্রকাশ করুন। প্রতিবাদ করুন। পাশে দাঁড়ান। আর যেন কোনো রাজীবকে এইভাবে মরতে না হয়।
১৫ বছরের অবিচারের অবসান ঘটাতে গ্রামীণ ফোনের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদকে সতর্ক করে তিনি আরো বলেন, “৩০ জুন ২০২৫-এর মধ্যে গ্রামীণফোন সমস্যার সমাধান না করলে, আরও কঠোর দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমরা পিছপা হব না।”
এদিকে বিভিন্ন দেশে থাকা গ্রামীণ ফোনের সাবেক কর্মীরাও এখন এই নিয়মিত প্রতিবাদ সমাবেশের একাত্মতা প্রকাশ করে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। পাশাপাশি ৩২৮১ জন সাবেক কর্মী আন্দোলনের সপেক্ষে পিটিশনে সই করেছেন।
প্রসঙ্গত, গত ৮ জুন গ্রামীণ ফোনের কমার্শিয়াল ডিভিশনের ডিস্ট্রিবিউশন ও রিটেইল সেলস বিভাগের সাবেক সিনিয়র টেরিট ম্যানেজার রাজীব মাহমুদ শান্ত একেবারেই শান্ত হয়ে যান। বাসাতেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়ার পরে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর গোরস্থানে।
রাজীবের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, গ্রামীণফোনে চাকরিরত অবস্থায় বাইক দুর্ঘটনায় ঘাড় ও মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলাম। এখন এটি স্থায়ী অসাড়তা, জ্বালাপোড়া, ও চলাফেরার অক্ষমতা রোগে আক্রান্ত হন তিনি। পরে রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ (RHD) এবং আইডিওপ্যাথিক থ্রোম্বোসাইটোপেনিক পারপুরা (ITP) পেয়ে বসে থাকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতিদিন Eltropag ও Epotin ইনজেকশন, অক্সিজেন, ড্রেসিং, ফিজিওথেরাপি দিতে হতো। এছাড়াও মাঝে মাঝেই রক্ত বা প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন করতে হতো। CMC Vellore (ভারত) হতে স্পাইন ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। তবে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা হওয়ায় বকেয়া পাওনার জন্য হাসপাতালের বেড থেকে অনলাইনে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন রাজীব। ফেসবুক পোস্টে প্রতিবাদ জানিয়ে দাবিও করেন।
‘কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোক দেখানো নানা সিএসআর করলেও প্রাক্তন কর্মী রাজীবের প্রাপ্য মিটিয়ে দেয়ার আহাজারি শুনে তার পাশে দাঁড়ায়নি গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ’- এমন অভিযোগ করেছেন তার সহযোদ্ধারা।