স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে দুশ্চিন্তা থাকে ফোনে চার্জ থাকা নিয়ে। ফোন কেনার সময় স্ক্রিনের মাপের পাশাপাশি একবার চার্জে কতক্ষণ যাবে সে ফিচারটি জানার চেষ্টা করেন স্মার্টফোন ক্রেতারা। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কানটারের ওয়ার্ল্ড প্যানেল কমটেকের তৃতীয় প্রান্তিকের গবেষণা অনুযায়ী, স্মার্টফোনে দুর্দান্ত ক্যামেরার চেয়ে এর ব্যাটারিকে বেশি গুরুত্ব দেন ক্রেতারা। এ ছাড়া স্মার্টফোনের আয়ুর সঙ্গে এর ব্যাটারি কত দিন টিকবে, সেটিও জানার আগ্রহ থাকে ক্রেতাদের।
এখনকার যুগে স্মার্টফোনে দ্রুত চার্জিং সিস্টেম আসার পর ব্যাটারির আয়ু নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে। এখন যদি দিন ফুরানোর আগেই ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যায়, তখন দ্রুত মোবাইলে চার্জ দেওয়ার বিষয়টি ভাবনায় থাকে। ১০ মিনিট চার্জ দিতে পারলেও অনেক ক্ষেত্রে নানা কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।
এখন অনেক ফোনের বাক্সে দ্রুতগতির বা ফাস্ট চার্জার দেওয়া হয়। স্যামসাং, হুয়াওয়ে, ওয়ান প্লাস এমনকি অ্যাপলও দ্রুতগতির চার্জার দেয়। এখন অনেকে প্রশ্ন তোলেন, দ্রুতগতির চার্জার ব্যবহারে ফোনের ব্যাটারি কতটা টেকসই হবে? প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট সিনেট বিষয়টি নিয়ে ব্যাটারি গবেষক ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলেছে।
গবেষকেরা বলেছেন, অধিকাংশ মোবাইল ফোন ও ব্যক্তিগত ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে লিথিয়াম আয়ন রিচার্জেবল ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। কয়েক দশক ধরে ব্যাটারি প্রযুক্তিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি বলে দীর্ঘ সময় ব্যাটারিতে চার্জ ধরে রাখার বিষয়টি এখনো কঠিন। তবে এখনকার উন্নতির বিষয়টি এসেছে শক্তিসাশ্রয়ী কয়েকটি ফিচার যুক্ত হওয়ার পর। সফটওয়্যারের মাধ্যমে চার্জিং ও ডিচার্জিং বিষয়টি দক্ষভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়।
গবেষকেরা বলেন, প্রচলিত চার্জারের আউটপুট থাকে ৫ থেকে ১০ ওয়াট। দ্রুতগতির চার্জারে যা ৮ গুণ পর্যন্ত উন্নত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আইফোন ১১ প্রো ও প্রো ম্যাক্স মডেলের ১৮ ওয়াট ফাস্ট চার্জার, গ্যালাক্সি নোট ১০ ও নোট ১০ প্লাসে ২৫ ওয়াট চার্জার ব্যবহৃত হয়েছে। স্যামসাং আলাদা ৫০ ডলারে ৪৫ ওয়াটের চার্জার বিক্রি করে। যদি ব্যাটারি বা চার্জার ইলেকট্রনিকসে কোনো কারিগরি ত্রুটি না থাকে, তবে দ্রুতগতির চার্জার ব্যবহারের দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাটারির কোনো ক্ষতি হয় না।
ফাস্ট চার্জিং ব্যাটারি দুই ধাপে কাজ করে। প্রথম ধাপে খালি বা প্রায় খালি ব্যাটারিতে ভোল্টেজ বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রথম ১০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ চার্জ হয়ে যায়। চার্জের প্রথম দফার ব্যাটারি কোনো রকম নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াই দ্রুত চার্জ শোষণ করতে পারে। স্যামসাং দাবি করে, তাদের ৪৫ ওয়াটের চার্জার আধঘণ্টায় ৭০ শতাংশ চার্জ করে ফেলে। অ্যাপল দাবি করে, তাদের চার্জার ৩০ মিনিটে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ করে ফেলতে পারে। চার্জের দ্বিতীয় ধাপে ব্যাটারিতে ধীরে ধীরে চার্জ শুরু হয়। এ সময় ধীরে চার্জ না হলে ব্যাটারির ক্ষতি হতে পারে ভেবে সে অনুযায়ী চার্জারের ব্যবস্থা থাকে।
প্রযুক্তি সাইট আইফিক্সিটের বিশেষজ্ঞ আর্থার শি বলেন, ‘ব্যাটারিকে স্পঞ্জের সঙ্গে তুলনা করুন। যখন শুকনো স্পঞ্জ থেকে পানি শুষবেন, শুরুতে অনেক পানি শোষণ করতে পারবে। ব্যাটারির ক্ষেত্রে এটিই প্রথম ধাপ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ব্যাটারির কোনো ক্ষতি হয় না। ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দুটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করে।’
অনেক সময় স্মার্টফোনে অতিরিক্ত চার্জ দেওয়া নিয়ে উদ্বেগে থাকেন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘ সময় চার্জার ফোনে লাগিয়ে রাখলে ব্যাটারির আয়ু কমে যাবে। এ ছাড়া ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে আগুন ধরে যাওয়ার আশঙ্কা করেন অনেকেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আধুনিক স্মার্টফোনে ব্যাটারি ব্যবস্থাপনার সিস্টেমে এমনভাবে তৈরি করা থাকে যাতে ব্যাটারি শতভাগ চার্জ হয়ে গেলে চার্জ বন্ধ হয়ে যায়। এতে অতিরিক্ত চার্জ হওয়ার সুযোগ থাকে না।
আরগন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ব্যাটারি গবেষক ভেঙ্কাট শ্রীনিবাস বলেন, ব্যাটারির সার্কিটে কোনো সমস্যা হলে আধুনিক ফোনেও অতিরিক্ত সময় ধরে চার্জ দেওয়া যাবে না। এখন আধুনিক স্মার্টফোনে অতিরিক্ত চার্জ ঠেকানোর সিস্টেম বিল্ট ইন থাকে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ স্মার্টফোন ৮০ শতাংশ বা তার আশপাশে চার্জ রাখার কথাও বলেন। এতে স্মার্টফোনের ওপর চাপ কমে। স্মার্টফোন নিয়মিত চার্জিং চক্র রাখলে ব্যাটারি বেশি দিন টিকবে বলে মনে করেন তাঁরা। এ ছাড়া ব্যাটারি পুরোপুরি চার্জশূন্য করতে নিষেধ করেন গবেষকেরা। এতে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে ব্যাটারির আয়ু কমে যেতে পারে। ব্যাটারির ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের বেশ কিছু সেফটি ফিচার আছে, যা ব্যাটারি একেবারে চার্জশূন্য হওয়া ঠেকাতে পারে। ব্যাটারির চার্জ ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এলে চার্জ দেওয়া উচিত।
মনে রাখতে হবে, স্মার্টফোনের ব্যাটারির সবচেয়ে বড় শত্রু অতিরিক্ত তাপমাত্রা। বেশি তাপমাত্রায় স্মার্টফোনের ব্যাটারি কমতে শুরু করে। তাই সরাসরি স্মার্টফোন রোদে রাখা ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গরমে ফোন বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। ৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার ওপরে গেলেই ব্যাটারির কার্যকারিতা কমতে শুরু করে। তাই ফোনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা যাতে না বাড়ে, সে জন্য খেয়াল রাখতে হবে। রোদে বা ড্যাশবোর্ডে ফোন রাখলেও তোয়ালে দিয়ে ঢেকে বা পানির বোতলের পাশে রাখতে হবে।
ভুয়া বা নকল চার্জার, কেবল ব্যবহার না করলে নিজ স্মার্টফোনের কেবল ছাড়া অন্য কেবল বা চার্জার ব্যবহারে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। তবে নিজের ডিভাইসের সঙ্গে দেওয়া চার্জার ও কেবল ব্যবহারই সবচেয়ে নিরাপদ।
সাধারণত ব্যাটারির চার্জ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে স্মার্টফোনের ব্রাইটনেস কমিয়ে রাখা, ওয়াই-ফাই ও ব্লুটুথ সংযোগ প্রয়োজন না হলে বন্ধ রাখা, সেটিংস থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড ডেটা ব্যবহার বন্ধ করার মতো কাজগুলো স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মানতে হবে।