২০১৯ সালে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর খাতের আয় কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধের জেরে গত বছরজুড়ে সেমিকন্ডাক্টর বিক্রিতে শ্লথগতি বিরাজমান ছিল। যে কারণে গত বছর সেমিকন্ডাক্টর বিক্রি থেকে আয় ৪১ হাজার ৯১০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
গার্টনার জানায়, গত বছরজুড়ে মেমোরি চিপের বাজার নিম্নমুখী থাকায় সেমিকন্ডাক্টর খাতে স্যামসাংয়ের মতো শীর্ষস্থানীয় ভেন্ডরের আয় কমেছে, এমনকি তা আগের দুই বছরের চেয়েও কম। তবে গত বছর সেমিকন্ডাক্টর বাজারে স্যামসাং খারাপ সময় পার করলেও ইন্টেলের জন্য দারুণ কেটেছে। মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি গত বছর বাজারে শীর্ষ অবস্থান পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর বাজারের শীর্ষ অবস্থান দখলে রেখেছিল স্যামসাং ইলেকট্রনিকস।
বিবৃতিতে গার্টনারের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু নরউড বলেন, গত বছর ডিআরএএম (ডাইন্যামিক র্যানডম অ্যাকসেস মেমোরি) চিপের অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে সামগ্রিকভাবে মেমোরি চিপ বাজার ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ পড়ে যায়। গত বছর মোট যে পরিমাণ সেমিকন্ডাক্টর বিক্রি হয়, তার ২৬ দশমিক ১ শতাংশ ছিল মেমোরি চিপ।
সামগ্রিকভাবে গত বছর সেমিকন্ডাক্টর বাজারের ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ এনএএনডি মেমোরি চিপের দখলে ছিল। তবে মেমোরি বিক্রি থেকে গত বছর আয় কমেছে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছর ডিআরএএম মেমোরি চিপ বিক্রি থেকে আয় কমেছে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শেষ দিকে হঠাৎ চাহিদা কমে যাওয়ায় ডিআরএএম মেমোরি চিপ বাজারে সরবরাহ চাপ তৈরি হয়, যা গত বছরজুড়ে অব্যাহত ছিল। চাহিদার এ পতনের কারণে ডিআরএএম মেমোরির দামও কমে যায়। গত বছর ডিআরএএম মেমোরির গড় মূল্য ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে।
গত বছর বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর বাজারে হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে ইন্টেল। বাজারটিতে বড় ধরনের সরবরাহ ঘাটতির মুখে পড়ায় শীর্ষ অবস্থান হারিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা পেয়েছে স্যামসাং। অন্যান্য ভেন্ডরের মতো স্যামসাং অতিরিক্ত সরবরাহ এবং ডিআরএএম ও এনএনএনডির দরপতনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর শুধু মেমোরি চিপ বিক্রিতে স্যামসাংয়ের আয় কমেছে ৩৪ শতাংশ। অথচ প্রতিষ্ঠানটির মোট আয়ের ৮৪ শতাংশই এ খাত থেকে আসে।
বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর খাতে ইন্টেল এবং স্যামসাংয়ের পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে এসকে হাইনিক্স, মাইক্রোন টেকনোলজি, ব্রডকম, কোয়ালকম, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস, এসটি মাইক্রোইলেকট্রনিকস ও এনএক্সপি সেমিকন্ডাক্টারসের মতো প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল।
বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ডিভাইসগুলোর জন্য চিপের চাহিদা। এর ফলে সম্প্রসারণ হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বা চিপের বাজার। ক্রমবর্ধমান এ খাতের রাজস্বে ২০১৮ সালের আগে টানা তিন বছর উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। তবে গত বছরের প্রথমার্ধে খাতটির রাজস্ব হ্রাস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা সৃষ্টি করে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যে, বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর খাতের রাজস্ব সংকুচিত হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, মূল ধারার ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের দুর্বল চাহিদা, বিভিন্ন অঞ্চলের মুদ্রার বিপরীতে শক্তিশালী ডলার এবং নতুন উদ্ভাবন কমে আসা। অটোমোটিভ, মোবাইল ফোন এবং ক্লাউড অবকাঠামোগত উদ্ভাবনে এক ধরনের স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। যে কারণে চীনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্মার্টফোন বাজারগুলোয় বিক্রি কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেমিকন্ডাক্টর খাতের রাজস্বে।
বিশ্বজুড়ে ক্লাউড অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, ফাইভজি ডিভাইস ব্যবহার, ওয়াই-ফাই ৬ অ্যাডপশন, অটোমোটিভ সেন্সরস, পাওয়ারট্রেইন প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ট্রেনিং অ্যাকসেলেটর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর খাতের রাজস্ব প্রবৃদ্ধির অন্যতম অনুষঙ্গ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গার্টনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে চলতি বছরের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক বাজারে স্মার্টফোন সরবরাহ উল্লেখযোগ্য কমবে, যা সেমিকন্ডাক্টর বাজারের মন্দা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধ সেমিকন্ডাক্টর খাতের রাজস্ব কমার অন্যতম কারণ। বৃহৎ অর্থনীতির দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধের কারণে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়েছে। অনেকে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধের কারণে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তি শিল্প খাতে সরবরাহ কমছে। যে কারণে চাহিদা কমছে এসব ডিভাইসের অত্যাবশ্যকীয় চিপের।
বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর খাতে প্রতিযোগিতা অনেক বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আগামীতে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একীভূতকরণ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধ নিরসন এবং কভিড-১৯ মহামারীর অবসান হলে সেমিকন্ডাক্টর খাতের আয়ে উল্লম্ফন দেখা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।