ঘরে বাইরে একসাথে সামাল দিতে নারীদের জুড়ি মেলা ভার। সেইসাথে যদি নিজের উদ্যোগ নিতে মন চায় আর সেই চাওয়া পূর্ণতা পায় তখন পরিশ্রম দিতে হয় আরো বেশি করে।এমন ই একজনের গল্প আজ আমরা জানতে চলেছি।৪৪বছর বয়সেও যিনি নিজের উদ্যোক্তা জীবন পরিচালনা করছেন দক্ষ হাতে। শিক্ষক দম্পতির একমাত্র মেয়ে সন্তান নাহিদ সুলতানা বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত। নাহিদ সুলতানার মায়ের অনুপ্রেরণায় উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি, টিউশনি করেছেন। হিসাববিজ্ঞানে তিনি স্নাতক- স্নাতকোত্তর করার পরে কস্ট এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টিং এ ইন্টারমিডিয়েট কোর্স করেছেন। এরপর তিনি ২০০০ সালে গ্রামীন ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন; এরপর এডুকেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এডুকো) নামে একটি ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে ম্যানেজার এডমিন এ্যান্ড ফাইন্যান্স হিসাবে ১৪ বছর চাকরি করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০১৯ সালে নিজের উদ্যোগকে সময় দেয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন পথ চলা শুরু করেন। তাঁর জলরঙ উদ্যোগের নাম এবং এটি হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ির উদ্যোগ।
টেকজুমঃ জলরঙ পথচলার গল্প কেমন ছিলো?
নাহিদ সুলতানাঃ পোশাকের ক্ষেত্রে আনকমন কিছু পরার ইচ্ছে থেকেই আমার বোনের মেয়ে শায়লা জিন্নাত রুনিকে অনুরোধ করে মসলিন ও রাজশাহী সিল্ক শাড়ীতে হ্যান্ড পেইন্ট করিয়ে বিভিন্ন অফিসিয়াল ও পারিবারিক প্রোগ্রামে পরতাম। রুনি পেইন্টিং -এ মাষ্টার্স করেছে। এমনকি ২০০৫ সালে আমার গায়ে হলুদের শাড়িটিও ছিলো হ্যান্ডপেইন্ট করা।সবার কাছ থেকে প্রশংসা পেতাম,কেউ কেউ অনুরোধ করত তাদের জন্যও করে দিতে। এভাবে একসময় মনে হলো আমি এ নিয়ে উদ্যোগ গ্রহন করি, সবার কাছে পৌছে দেই আমার ভালো লাগার পোশাক। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে চাকরির পাশাপাশি আমার উদ্যোগ জলরঙ এর যাত্রা শুরু হলেও ২০১৯ সালের শুরুর দিক থেকেই চাকরির পাশাপাশি জলরঙ-কে চালানো এবং এর কলেবর বৃদ্ধি করা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে, দিনে ২/৩ ঘন্টা ঘুমিয়ে সব দিক সামাল দিতে পারছিলাম না। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারন আমার সাথে জলরঙ যারা কাজ করতো তাদের রুটিরুজির দায়িত্বটা আমার উপরে বর্তায়, আর ব্যবসাটা যত ছোট হোক সেটা আমার নিজের। এপ্রিল ২০১৯ থেকে শুরু হলো নতুন জীবন।শুরুতে রাজশাহী সিল্ক ও মসলিন শাড়ীতে হ্যান্ডপেইন্ট করার পরিকল্পনা করি। পরে কাষ্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতেও কাজ করা শুরু করি। ধীরে ধীরে আর্টিষ্ট এর সংখ্যা বাড়ে।শাড়ীর পাশাপাশি একে একে মসলিন ও সুতি থ্রীপিস, ওড়না, ফতুয়া প্রডাক্ট লাইনে যোগ হয়।বর্তমানে ৬ জন আর্টিষ্ট জলরঙের সাথে কাজ করেন।২০১৯ সালে চাকরি ছাড়ার পরে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি, ফ্যাশন ডিজাইনের উপর পড়াশুনা করেছি, ই-কমার্স এর উপর নিজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি এবং এখন জলরঙ এর ওয়েবসাইট নিয়ে কাজ করছি।
টেকজুমঃ পরিবার আর উদ্যোগ একসাথে সামলান কিভাবে?
নাহিদ সুলতানাঃ আমার স্বামী ডঃ আলীম আল রাজী সবসময় আমাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেন,ছেলেকে সামলানো হোক বা সোর্সিং এর জন্য প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়া হোক সব কাজে তিনি পাশে থাকেন। এর বাইরেও আমার মা তার যথাসাধ্য সাপোর্ট দেন আমাকে।
টেকজুমঃ হ্যান্ডপেইন্টিং এর উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে চাইলে কেমন প্রস্তুতি প্রয়োজন?
নাহিদ সুলতানাঃ হ্যান্ডপেইন্টিং নিয়ে কাজ করার জন্য প্রথমে এ বিষয়ে খুব ভালো ভাবে জেনে নিতে হবে।নিজে ফাইন আর্টস পড়ে থাকলে সবচেয়ে ভালো।নতুবা এ বিষয়ে যথাযথ ট্রেনিং নিয়ে নিতে হবে। কারন জলরঙে যে আর্টিষ্টরা কাজ করেন তারা সবাই ফাইন আর্টসে এ গ্রাজুয়েজন করার পরেও ৬ মাস আমাদের এখানে ট্রেনিং করে তার কাজে হাত দিয়েছেন।তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব প্রয়োজন।
টেকজুমঃ ভবিষ্যত কেমন দেখেন দেশিপণ্য হিসেবে আপনার উদ্যোগ নিয়ে?
নাহিদ সুলতানাঃ হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে আবারও বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে চাই, আগের সেই হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে চাই।অন্যান্য বাংলাদেশি ফেব্রিক,হ্যান্ডপেইন্টের নতুন নতুন ফিউশন, প্রোডাক্ট রেঞ্জ ও ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে চাই, যেতে চাই বহুদূর।স্বপ্ন দেখি একদিন মানসম্মত দেশি পোশাক আর জলরঙ সমার্থক শব্দ হবে।
টেকজুমঃ উদ্যোগের অন্তরায় গুলো কিভাবে প্রতিরোধ করা বলে আপনি মনে করেন?
নাহিদ সুলতানাঃ এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে সাধারন মানুষের ভালো আইডিয়া নেই, তাই এর মূল্যায়ন করতে চায় না। একটা শাড়ী করতে যেখানে ৩-৪ দিন সময় লেগে যায় সেই শৈল্পিক কাজের মূল্য দিতে চায় না।এটি যে একটি শিল্প, সেই স্বীকৃতিটা আগে প্রয়োজন।সাধারন মানুষকে এটা নিয়ে আরো বেশি বেশি করে জানানো দরকার।
টেকজুমঃ আপনার সফলতার অনুপ্রেরণা এবং কৃতিত্ব কাকে বা কাদেরকে দিতে চান এবং কেন?
নাহিদ সুলতানাঃ আমার স্বামীসহ আমার পুরো পরিবার আমার সাথে ছিলেন বলেই আমি এতদূরে আসতে পেরেছি। এমনকি আমার ৭ বছর বয়সী ছেলেও আমাকে সহযোগিতা করে।এর পাশাপাশি আমার বোনের মেয়ে শায়লা জিন্নাত রুনির সহযোগিতা না থাকলে এতোদূর আসা সম্ভব হতো না।আমার পরিবারের পাশাপাশি উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) প্ল্যাটফর্ম পাশে ছিলো সবসময়ই। বিশেষ করে রাজিব আহমেদ স্যারের সরাসরি গাইডলাইন পেয়েছি অনলাইন ওয়ার্কশপগুলোতে। এবং স্যারের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ(ডিএসবি) থেকে থেকে ব্যবসার টেকনিকাল দিকসহ অনেক খুঁটিনাটি টিপস শিখেছি যেটি ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করেছে।
টেকজুমঃ চমৎকার লাগলো আপনার পথচলা। ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য নাহিদ আপনাকে এবং শুভকামনা রইলো আপনার জলরঙ এর জন্য।
নাহিদ সুলতানাঃ আমিও ধন্যবাদ জানাই টেকজুমকে।