প্রযুক্তি নির্ভরতায় হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের ‘প্রাইভেসি’ তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’। বিশেষ করে ফোনালাপ ফাঁস এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এই গোপনীয়তাকে সুরক্ষা প্রদানের সুযোগ রয়েছে। তবে নেই আইনের কার্যকর প্রয়োগ।
প্রায় সাতশ’ বছর আগেই ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৩৬১ সাল থেকেই এই অধিকার স্বীকৃত। ১৮৯০ সালে হার্ভার্ড ল রিভিউতে ‘দ্য রাইট টু প্রাইভেসি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রাইভেসি এস এন আসপেক্ট অব হিউম্যান ডিগনিটি’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। তাতে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়।
এ ছাড়াও সর্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর সব আধুনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংরক্ষিত।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি উঠে এসেছে আমাদের সংবিধানেও। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যক্তির গোপনীয়তাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। এমনকি বিটিআরসির আইনেও বলা হয়েছে ফোনে আড়িপাতা অপরাধ। ফোনালাপে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিটিআরসিকে।’
২০০১ সালের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রতিষ্ঠা হয়। এ আইনের ধারা ৩০(চ) অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের গোপনীয় রক্ষা নিশ্চিত করা এই কমিশনের দায়িত্ব।
ওই আইনের ৭১ ধারা অনুযায়ী আড়িপাতা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তি দুই বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
স্পষ্ট বিধিবিধান সত্ত্বেও প্রায়শই নাগরিকদের এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যত্যয় ঘটছে দাবি করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। তারা তাদের রিট আবেদনে ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ২০টি আড়িপাতার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও রিটে বিটিআরসিকে আড়িপাতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কমিশনকে তাদের আইনগত ভূমিকা পালনের জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
‘আমরা দেখেছি, দেশে একটার পর একটা ঘটনায় ফোনে আড়িপাতা ও ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ কমিশন তাদের দায়িত্ব পালন করছে না’- বললেন রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট বিচারপতি মো. শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ‘মো. আনিস মিয়া বনাম দ্যা স্টেট, ফৌজদারি আপিল নম্বর- ৬৭৯৯ এর ২০১১’ মামলায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। ওই রায়ে বলা হয়, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও টেলিফোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সর্বাধিক। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ তাদের দায়িত্ব।
বিটিআরসি’র লিগ্যাল অ্যাডভাইজর ব্যারিস্টার খন্দকার রেজা ই রাকিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিটিআরসির কাজের অধিক্ষেত্রটি বিশাল। এখানে স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও টেলিকমিউনিকেশনের মতো মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। এদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। সময়ে সময়ে আইনের প্রসঙ্গ পরিবর্তন হচ্ছে। এগুলো পর্যবেক্ষণে প্রচুর জনবল দরকার। তবে বিটিআরসি’র বিদ্যমান আইনে ফোনে আড়িপাতার বিষয়ে বলা আছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি মনে করে তবে তারা আড়ি পাততে পারেন। তবে প্রাইভেট কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে এমন কোনও সুযোগ আইনে নেই।’
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বিটিআরসির আইন অনুসারে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের অনুমতি নিয়ে ফোনে আড়িপাততে পারে। তবে একজন ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতা বা ফোনালাপ ফাঁস করতে পারবে কি? এসব করতে সরকার অনুমতি দিয়েছে কিনা সেটা বিটিআরসি জানাক। আমরা রিট মামলার মাধ্যমে এসব বিষয়ে বিটিআরসির কাছে জানতে চাইবো।