টক-মিষ্টি স্বাদের ফল করমচা।বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় করমচা ফলটি চট্টগ্রামের প্রায় সব জায়গায় চাষ হচ্ছে এবং জনপ্রিয়তা ও পাচ্ছে ফল হিসাবে। ইংরেজিতে এর নাম- Bengal currant /Christ’s thorn. কাঁটাময় গুল্মজাতীয় করমচা উদ্ভিদটির আদি স্হান হিসাবে এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশকে চিহ্নিত করা হয়।
কাঁচা অবস্হায় এই ফল সবুজ, পরিণত অবস্থায় যা ম্যাজেন্ডা লাল-রং ধারণ করে। অত্যন্ত টক স্বাদের এই ফলটি খেতে ভালো লাগলেও, এই ফলের গাছ বিষাক্ত। করমচার ঝোপ দেখতে সুন্দর।বর্তমানে ফলটি গ্রাম থেকে এখন শহরেও চাষ করা হয়। বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দায়ও এখন চাষ হচ্ছে করমচা।করমচার গাছ, পাতা ও ফল সৌন্দর্যবর্ধন করে বিধায় এই কাটাযুক্ত গাছ অনেকে রোপণ করে থাকেন।
করমচা নিয়ে কবিরা ছড়া ও লিখেছেন- ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে, লেবুর পাতায় করমচা যা বৃষ্টি ঝরে যা’।
** করমচা গাছের বিবরণঃ
করমচা গাছ বেশ ঝোপতলা ধরনের শক্ত জাতের কাঁটাওয়ালা গুল্ম।
** ফুলের বিবরণঃ
বড় সাদা ও ফিকে গোলাপি রঙের সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত করমচা ফুল দেখতে কিছুটা কুন্ধ ফুলের মতো।
**ফলের বিবরণঃ
কাচাঁ অবস্হায় ফলের রঙ গাঢ় সবুজ, পাকলে লাল হয়। কোনো কোনো জাতের ফলের গায়ে খয়েরি দাগ থাকে। চেরি ফলের মতো দেখতে করমচা ফল বেশ শাঁসালো, ভেতরে ছোট ছোট চার-পাঁচটি বীজ থাকে। গাছ ও ফলে দুধের মতো আঠালো রস রয়েছে।
**ফুল ও ফল ধরার সময়ঃ
ফেব্রুয়ারি মাসে গাছে ফুল আসে এবং ফল ধর এপ্রিল-মে মাসে। বর্ষায় ফল পাকে। অনেক সময় কোন কোন গাছে কমবেশি প্রায় সারা বছরই করমচা ফলে।
**করমচা গাছের জন্য উপযুক্ত পরিবেশঃ
করমচা গাছ গরম, আর্দ্র কিংবা শুষ্ক পরিবেশে ভালো জন্মে। বেলে-দোআঁশ বা হালকা মাটিতে করমচা ভালো জন্মায়। অম্লমাটি অপেক্ষা কিছুটা ক্ষারভাবাপন্ন মাটি বেশি পছন্দ করে। করমচা চাষের জন্যে জমি উঁচু হলেই ভালো।
**চারা রোপনের খুটিনাটিঃ
গাছ লাগানোর জন্য ১৫থেকে২০ দিন আগে থেকে গর্ত বানিয়ে রাখতে হবে।গর্তের মাঝখানে চারা বসিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। চারার গোড়ার মাটি শক্তভাবে চেপে দিতে হবে; যাতে গাছ পড়ে না যায়। বর্ষাকালে চারা রোপণ করা ভালো। এতে বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না। শীতকাল বাদে অন্য সময়েও চারা রোপণ করা যায়। সার প্রয়োগ ক্ষেত্রে প্রতি বছর বর্ষার আগে করমচা গাছের গোড়ার মাটির সাথে ১০ কেজি কম্পোস্ট সার ২৫ গ্রাম সুফলা মিশিয়ে দিলে উপকার হয়। বড় গাছে সার প্রয়োগের প্রচলন কম হলেও ভালো ফলন পেতে গোবর সারের সাথে ৫০ গ্রাম সুফলা দিতে হয়।
**ফল শেষে করণীয়ঃ
প্রতিবার ফল শেষ হয়ে যাওয়ার পর ঘন ডালপালা ছেঁটে কিছু হালকা করে দেয়া দরকার। গোড়ায় মাটি ধরিয়ে বর্ষার আগে একটু উঁচু করে দিতে হবে। যাতে বৃষ্টির পানি না দাঁড়ায়। মাঝে মধ্যে গোড়ায় মাটি আগাছামুক্ত করে হালকা করে কুপিয়ে দিতে হবে।
**করমচার পুষ্টি ও ওষুধি গুণের বর্ণনাঃ
করমচা ফলের ১৮.২ ভাগ জলীয় রস, ২.৩ ভাগ প্রোটিন, ২.৮ ভাগ খনিজ, ৯.৬ ভাগ স্নেহ, ৬৭.১ ভাগ শর্করা। এছাড়া খনিজের মধ্যে ক্যালসিয়াম ০.১৬ ভাগ, ফসফরাস ০.৬ ভাগ এবং লৌহ ৩৯.১ ভাগ। প্রতি ১০০ গ্রাম করমচা থেকে পাওয়া যায় ৩৬৪ ক্যালরি তাপ, রিবোফ্লেভিন ০.১ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.২ মিলিগ্রাম, আয়রন ১.৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ১৬ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৬০ মিলিগ্রাম, কপার ০.২ মিলিগ্রাম এবং ১০০ গ্রাম তাজা ফলে রয়েছে ২০০.৯৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি।
ভিটামিন সি-তে ভরপুর করমচা মুখের রুচি বাড়াতে সহযোগিতা করে।দাঁত ও মাড়ির যত্ন নেয়।রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রেখে হৃৎপিণ্ডের সুরক্ষা দেয়। শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ কমাতেও সাহায্য করে। যকৃত ও কিডনির রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। মৌসুমি সর্দি-জ্বর, কাশিতে করমচা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এদিকে করমচাতে বিদ্যমান ভিটামিন এ চোখের জন্য খুবই উপকারী। ত্বকের যত্ন নেয়। কৃমিনাশক হিসেবে ও ওষুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।পেটের নানা অসুখের দাওয়াই করমচা। শরীরের ক্লান্তি দূর করে করমচা শরীরকে চাঙা রাখে।বাতরোগ কিংবা ব্যথাজনিত জ্বর নিরাময়ে করমচা খুব উপকারী।করমচা ওজন কমাতেও সাহায্য করে।শরীরের ক্লান্তি ও বার বার হাই তোলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য করমচার রস বেশ কাজে দেয়।করমচার কার্বোহাইড্রেট কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
**করমচা পাতার কারিশমাঃ
করমচা গাছের পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি পান করলে কালাজ্বর দ্রুত নিরাময় সাধন করে।
**করমচা মূলের উপকারীতাঃ
করমচা গাছের মূলে রয়েছে হৃদরোগ নিরাময়ে উপকারী ক্যারিসোন, বিটাস্টেরল, ট্রাইটারপিন, ক্যারিনডোনা ও লিগনাম।
বহুগুণে গুণান্বিত এই ফল আমরা আমাদের খাদ্য তালিকায় রাখতে পারি।সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য চাষ ও করতে পারি।এতে আমাদের শরীরের পাশাপাশি মন ও উপকৃত হবে।সৌখিন বাগানীদের বাগানের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিবে করমচা গাছ আর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল শরীরে দিবে ভিটামিনের যোগান।
রাহাত সোলতানা
স্বত্বাধিকারী-অভিরুচি বুটিকস