’দেশীয় শাড়ি’ শব্দ গুলো আলাদা হলেও এর সাথে যেন বাংলার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি বেশ জড়িত। বাংলাদেশর শাড়ির ইতিহাস অনেক পুরনো ও সমৃদ্ধ। পাশ্চাত্য দেশের অনেক জ্ঞানী গুণীজনরা বাংলাদেশ ঘুরে তাদের লেখনীতে শাড়ি ও কাপড়ের প্রশংসা করেছেন।
তবে আজকের গল্পটা আমরা ইতিহাস নিয়ে করবো না। আজকের গল্পে ফিরে যাব একদম শিশুর জন্মের মুহুর্তে। আতুরঘরে নতুন অতিথির আগমনে মায়ের নরম শাড়িতেই আগলে স্বাগত জানানো হয়।
নরম শাড়ির ভাজে ভাজে বিড়া বানিয়ে দেয়া হয় মাথার নিচে শিশুদের প্রথম বালিস হিসেবে। আধুনিক সব সরঞ্জাম যখন ছিলনা তখন মায়েরা কাঁথা বানাতেন নানি দাদিদের পরনের নরম কাপড় দিয়ে৷ তাতে শিশুদের কোমল শরিরে র্যাশ উঠতোনা বরং পরম মমতায় যেন আগলে থাকতো তারা তুলতুলে নরম কাঁথা গুলোতে।
উপহার হিসেবে দেয়া হতো নতুন শিশুকে হাতের কাজ করা এক রঙ শাড়ি বা নরম কাপড়ে ফুল নকশা তোলা নানা রঙ এর কাঁথা গুলো। সেই কাথায় শিশু পার করতো তার পৃথিবীতে আসার প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর।
হাটি হাটি পা পা করে হাটতে শেখা ছোট্ট পুতুল যেন মায়ের আচল ধরেই খুজে নিত তার নির্ভরতা। মা যেদিকে যেও সেদিকে এক পা দু পা করে আগাতে আগাতে শিখে ফেলে দাঁড়িয়ে পরা। হামাগুড়ির দিন গুলোতেও যেন মায়ের গায়ের ঘ্রান খুজেই সে পেয়ে যেত নির্ভরশীল অবস্থান মায়ের শাড়ির মধ্যে কোল জুড়ে পরম প্রশান্তি।
ছোটাছুটি করার বয়সে যেন মাঠ থেকে ফিরেই মায়ের আচল হয়ে যায় আসল যায়গা৷ গোসলের পরেও যেন ইচ্ছে করে চুল ভিজিয়ে রাখা মা যেন জোর করে তা মুছে দেন তার আচলে। মায়ের শাড়ির আচল জুড়েই যেন মমতা ও শাসন দুটোই ছেলে বেলায় আগলে রাখে।
মায়ের শাড়ি দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাওয়া মেয়েটা লুকিয়ে মায়ের শাড়িই প্রথম পরে। কোন বিয়ের প্রোগ্রামে বা গায়ে হলুদে লোভ থাকে মায়ের সব চেয়ে সুন্দর শাড়িটার প্রতি। আর সেই শাড়ি নস্ট করে ফেরার অপরাধো তাই আজীবন মনে রয়ে যায়।
প্রতিটি মেয়ের কাছে প্রথম শাড়ি পরার স্মৃতি, তাই খুব বেশি আপন৷ সবাই দেখে যখন তাকে জানায় একদম মায়ের মতো লাগছে বড় হয়ে যায় সেই মুহুর্তেই মেয়েটা। নিজেকে যেন আবিষ্কার করে কল্পনায় সেও এক সময় মায়ের মতো হবে পরম মমতায় আগলে রাখবে পুরো পরিবার৷ তার আচলেই যেন বাধা পরবে নতুন কোন পরিবারের চাবি!
স্কুলের নবীন বরনের স্মৃতি গুলোতেই যেন থাকে নতুন করে নিজেকে জানার আগ্রহ বন্ধুদের দেখিয়ে তার মায়ের শাড়ি পরার সাহস ও বাহবা কুড়ানোর প্রতিযোগিতায় যেন প্রতিটি মেয়ে মেতে ওঠে। স্কুল থেকে কলেজে ওঠার পরে যেন শাড়ি পরতে ইকটু বাহানাই যথেষ্ট৷ পহেলা ফাল্গুনের ঝরা পাতার রঙ গুলো হাফসিল্কের দেশীয় শাড়িতে দল বেধে আনন্দ করা। পহেলা বৈশাখ এর হৈ হুল্লোড় এর মাঝে সাদা শাড়ি লাল পাড়ে নিজেকে আল্পনায় একে নেয়া।
নিজের প্রথম প্রেমের মতোই মেয়েদের শাড়ির প্রতি মায়া ও ভালোবাসা কখনো কমেনা বরং সব সময়ই বাড়তেই থাকে। শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করে হোক বা টিউশন এর টাকা জমিয়ে হোক নিজের জন্য কেনা প্রথম শাড়িটার মায়া তারা শেষ বেলায়ও ভুলতে পারেনা।
মায়ের জন্য কেনা প্রথম উপহার যেন শাড়ি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা মেয়েরা। একটি জামদানীর শখ থাকে সব মেয়েদের কোন স্পেশাল উপলক্ষ ঘিরে বা প্রিয় জনের কাছ থেকে পাওয়া উপহার হিসেবে তারা জামদানীকেই বেছে নেয়।
ছোট্ট কন্যা যখন বড় হয়ে তার নারী চরিত্রের শোলকলা পরিপূর্ণ করতে নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তখন টুকটুকে লাল বেনারসি শাড়ির দিকে নজর পরে সবার আগে।
বিয়ের দিন টুকটুকে লাল বউ দেখেও সবাই যেন বউকে মিস্টি, গোলাপি, মেরুন রং এর কাতান, জামদানী উপহার হিসেবে দিতে পছন্দ করেন৷ যেন নতুন বউ এর আভা ছড়ানো রুপ এক কথায় মুগ্ধ করে সবাইকে।
নতুন বউ এর আচলে তখন ওঠে নতুন ঘরের চাবি শুরু হয় তার জীবন চক্র। ছোট্ট শিশু, কন্যা, কিশোরী, যুবতী, বউ ও মা পুরোটা জীবন জুড়েই যেন সে শাড়ির সাথে জড়িয়ে নেন নিজেকে।
দেশীয় শাড়ির সাথে জড়িয়ে থাকা নারীদের এই জীবন চক্র অনেকটা পরিবর্তন হলেও এখনো তা সমান ভাবে জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দেশীয় শাড়ির ব্যবহার ও প্রচার বৃদ্ধিতে পালিত হচ্ছে ’দেশীয় শাড়ি সপ্তাহ’। ই-ক্যাব এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট রাজিব আহমেদ এই ওয়েভ এর ডাক দেন পরিধান শৈলী গ্রুপের মাধ্যমে। এই ওয়েভের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে দেশীয় পন্যের ২৫০ টির বেশি ছোট গ্রুপ এগিয়ে এসেছেন।
নানা ধরনের শাড়ির সাথে দারুন সব কন্টেন্ট, ছবি, তথ্য ও গল্পে গল্পে জানাচ্ছেন দেশীয় শাড়ির ব্যবহার৷ উল্লেখিত ওয়েভে সব চেয়ে বেশিবার বলা হয়েছে জামদানী, খেশ, মনিপুরী, হাফসিল্ক, সিল্ক, দেশীয় ব্লক, বাটিক, কাতান ও নানা ধরনের শাড়ির নাম।
আশা করা যাচ্ছে আগামী বছর গুলোতে দেশীয় শাড়ির এই ওয়েভ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে দেশীয় শাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে। মান সম্পন্ন দেশীয় শাড়ি গুলো এতোটাই সম্বৃদ্ধ যে তা খুব সহজেই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
লেখক : সিরাজুম মুনিরা, স্বত্বাধিকারী আবায়া স্টোরি।