কম দামে পণ্য বিক্রির লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। রাজধানীর গুলশান থানায় এক ভুক্তভোগীর মামলার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল গ্রেপ্তার হন।
গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আরিফ বাকের নামে গুলশান থানায় করা মামলার বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, ইভ্যালিতে তিন লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকার পণ্য অর্ডার করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পাননি। নিরুপায় হয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেন তিনি।
মামলায় ইভ্যালি এমডি মোহাম্মদ রাসেলকে এক নম্বর আসামি ও চেয়ারম্যান শামীমাকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। এরপর রাসেল দম্পত্তির মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডের বিলাসবহুল বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, ইভ্যালি থেকে প্রতিমাসে রাসেল দম্পতি বেতন নিতেন ১০ লাখ। কোম্পানির অর্থে ব্যক্তিগত দুটি দামি গাড়ি (রেঞ্চ রোভার ও অডি) ব্যবহার করতেন। এছাড়া কোম্পানির প্রায় ২৫-৩০টি যানবাহন রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে তাদের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে।
কারাগারে থাকা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ৩০টির মতো মামলা হয়। বিভিন্ন সময় ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। এর মধ্যে বেশিরভাগ অভিযোগই টাকা পরিশোধ করে দীর্ঘদিন পণ্য না পাওয়ার। এই দম্পত্তি গ্রেপ্তারের আগে ইভ্যালির বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থার সুপারিশ করে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স বিষয়ক জাতীয় কমিটি। প্রতিষ্ঠানটি মোট ৪০৩ কোটি টাকা দেনায় রয়েছে বলে খবর আসে।
মামলা বৃত্তান্ত:
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাত এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে মামলাটি করেন কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী।
৪২০, ৪০৬, ৫০৬ ধারায় নথিভুক্ত মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ইভ্যালির ধানমন্ডি কার্যালয়ে তিনি ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের ইলেক্ট্রিক পণ্য সরবরাহ করলেও ইভ্যালি তার পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। পণ্য ডেলিভারি বাবদ পাওনা টাকা চাইলে তাকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরেকটি মামলা করেন একজন আইনজীবী। মামলার বাদী রিগ্যান এজাহারে বলেন, ইভ্যালিতে সাইক্লোন অফারটি দেখতে পান এবং একটি মোটরবাইক অর্ডার করেন। যার মূল্য ডিসকাউন্ট দিয়েছিল ৭০ হাজার ৯৯ টাকা ও বাজারমূল্য ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
এরপর অর্ডারকৃত পণ্যের জন্য ‘নগদ’ অ্যাপ ব্যবহার করে টাকা পরিশোধ করেন। ইভ্যালির নিয়ম অনুসারে ৭ দিন থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে বাইকটি বা বাইকের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও আসামিরা ১৪৯ দিনেও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য তিনি আদালতে মামলাটি করেন।
৩০ সেপ্টেম্বর রাসেল ও শামীমার বিরুদ্ধে ‘রঙ বাংলাদেশ’ চেক ডিজঅনারের দুইটি মামলা করে। ‘গিফট ভাউচার’ বিক্রির প্রাপ্ত চেকের টাকা নগদায়ন করতে না পারায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এ মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি।
১৮৮১ সালের দি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট-এর ১৩৮ ও ১৪০ ধারায় মামলা দুটি করা হয়। সেসময় ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ শেষে মামলা দুটি আমলে নিয়ে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের প্রতি সমন জারি করেন আদালত।
৯ ডিসেম্বর চেক প্রতারণার অভিযোগে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন তোফাজ্জল হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী। যেখানে শামীমা ও রাসেলকে অভিযুক্ত করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড়ে মোটরসাইকেল বিক্রির অফার অনলাইনের মাধ্যমে দেখতে পেয়ে বাদী। তিনি এক লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৫ টাকা পরিশোধ করে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেন। অর্ডারের ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি করার কথা ছিল। তা নাহলে মোটরসাইকেলের মূল্য বাবদ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা বাদীকে দেয়া হবে।
তবে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও মোটরসাইকেলটি ডেলিভারি করতে পারেনি ইভ্যালি। রিফাণ্ড হিসেবে সিটি ব্যাংকের একটি চেক ইভ্যালি দিলেও চেকটি ডিজঅনার হয়।
যেভাবে ব্যবসায়ী এই দম্পত্তি:
২০১৭ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন রাসেল দম্পত্তি। প্রায় এক বছর শিশুদের ব্যবহার্য একটি আইটেম নিয়ে ব্যবসা করে তিনি ওই ব্যবসা বিক্রি করে দেন।
২০১৮ সালে আগের ব্যবসালব্ধ অর্জিত অর্থ দিয়ে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে ইভ্যালির কার্যক্রম শুরু হয়। কোম্পানিতে তিনি সিইও ও তার স্ত্রী চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন।
ধানমণ্ডিতে ভাড়া করা বাড়িতে প্রধান কার্যালয় এবং কাস্টমার কেয়ার স্থাপিত হয়। একইভাবে ভাড়া করা স্পেসে আমিন বাজার ও সাভারে দুটি ওয়্যার হাউজ খোলে তারা।
কোম্পানিতে একপর্যায়ে প্রায় দুই হাজার ব্যবস্থাপনা স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ দেয়। কর্মচারীদের মোট মাসিক বেতন বাবদ দেওয়া হতো প্রায় ৫ কোটি টাকা।
গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ৩০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েকটি পেমেন্ট গেটওয়েতে ৩০-৩৫ কোটি গ্রাহকের টাকা আটকে আছে বলে র্যাবকে জানায় রাসেল। এই পরিস্থিতিতে ইভ্যালি আন্তর্জাতিক কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রির চেষ্টা চলছিল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির বকেয়া ২০৫ কোটি টাকার ওপরে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের কাছে বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ সাত হাজার ক্রেতা পাবে ৩১১ কোটি টাকা। আর পণ্য সরবরাহকারী মার্চেন্টরা পায় ২০৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাকি ২৬ কোটি টাকা পায় অন্য খাতের গ্রাহক। ইভ্যালির হিসাব অনুযায়ী, দায়ের বিপরীতে এর চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
জামিনে মুক্ত শামীমা:
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। বুধবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কারাগার থেকে শামীমা ছাড়া পান বলে কাশিমপুর মহিলা কারাগারের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ওই সূত্রটি বলছে, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে একটি সিআর মামলার জামিন সংক্রান্ত কাগজপত্র কারাগারে আসার পর যাচাইবাছাই করে শামীমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। শামীমা গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন।
ইভ্যালিকাণ্ডে ছয় মাস আগে গ্রেপ্তার হন শামীমা নাসরীন। তার বিরুদ্ধে ৩০টির মতো মামলা রয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই বাদীর সঙ্গে আপসের ভিত্তিতে শামীমা জামিন পান বলে জানা গেছে।