বাংলাদেশের যেসব নারী শাড়ি পছন্দ করেন, তাদের সংগ্রহে অন্তত একটি হলেও জামদানি শাড়ি থাকে। নান্দনিক ডিজাইন এবং দামে বেশি হওয়ার কারণে জামদানির সঙ্গে আভিজাত্য এবং রুচিশীলতা – এই দুটি শব্দ জড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যবাহী নকশা ও বুননের কারণে ২০১৬ সালে জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।
দেশে জামদানী সম্ভাবনা অনেক এবং এটির প্রচার ও বাড়ানোর জন্য ই-কমার্স অনেক বড় ভুমিকা পালন করতে পারে। উইতে আমরা মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে তাই দেখতে পাচ্ছি। বিক্রির জন্য দরকার প্রচার এবং আলোচনা করা। অনেকেই জানেন না যে বিয়েতে জামদানী অনেক সুন্দর মানায়। অনেকে এর সঠিক যত্ন নিতে যানেন না। উই গ্রুপে আমরা বিশেষ করে কাকলি আপু এদিকে প্রতিদিন পোস্ট দিচ্ছেন যার সাথে বিক্রির কোন সম্পর্ক নেই। সুজন ভাই জামদানীর পাঞ্জাবীকেও আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। এভাবে অনলাইনে চেষ্টা করলে এক বছরের মধ্যে জামদানী বিক্রি অনেক বেড়ে যাবে।
আসল জামদানি শাড়ি চেনার উপায়:
জামদানি শাড়ি কেনার আগে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে – শাড়ির দাম, সূতার মান এবং কাজের সূক্ষ্মতা। আসল জামদানি শাড়ি তাঁতিরা হাতে বুনন করেন বলে এগুলো তৈরি করা অনেক কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তাই এগুলোর দামও অন্যান্য শাড়ির তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে দুইজন কারিগর যদি প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা শ্রম দেন, তাহলে ডিজাইন ভেদে পুরো শাড়ি তৈরি হতে সাত দিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। সাধারণত শাড়ি তৈরির সময়, সূতার মান ও কাজের সূক্ষ্মতা বিবেচনায় একটি জামদানির দাম ৩,০০০ টাকা থেকে এক লাখ ২০,০০০ টাকা কিংবা তারচেয়েও বেশি হতে পারে।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) জামদানি
শাড়ি বাঙ্গালী নারীর ভালোবাসা এবং সৌন্দয্য। আর যদি তা হয় জামদানি, তাহলে কথাই নেই। জামদানি সকলের প্রথম পছন্দ। বহু আগে থেকেই জামদানির প্রচলন রয়েছে। উইকিপিডিয়াতে জানা যায় ১৭০০ সালের দিকে জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা। তখনকার সময় শুধু রাজা-বাদশারাই জমিদানি ব্যবহার করতো। বর্তমানে জামদানির শাড়ি, পাঞ্জাবি, জামা সহ অনেক কিছু তৈরি হয়। জামদানি শাড়িতে সব নারীকেই অপূর্ব লাগে।
যেখানে তৈরি হয় জামদানি
নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জ উপজেলার তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া মহল্লা জামদানির জন্মস্থান হলেও বর্তমানে জেলার রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের কিছু এলাকায় উৎপাদন হয় ঢাকাইয়া জামদানি। এসব এলাকার প্রতিটি পরিবারে গড়ে উঠেছে তাঁত কারখানা। প্রতিটি পরিবার বুনন, সুতা বিক্রি এবং রপ্তানি সহ কোন না কোন ভাবে জমদানি শিল্পের সাথে জড়িত। ক্রেতা-বিক্রেতার মিলন মেলা হিসেবে প্রতি শুক্রবার ভোরে ডেমরা ও নোয়াপাড়ায় বসে জামদানির হাট।
জামদানি তাঁতী
তাঁতিদের সরাসরি বই পুস্তকের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকলেও থেমে নেই এ শিল্পের তাঁতিরা। অনানুষ্ঠানিক পারিবারিক হাতে-কলমের শিক্ষা থেকেই তৈরি হয় ভবিষৎ জামদানি শিল্পের তাঁতিরা। তবে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় শৈশব এবং কৈশরের মাঝামাঝি সময় থেকে, নতুবা দক্ষ কারিগর হয়ে উঠতে পারে না। বুনন কাজে পুরুষদের দেখা মেলে বেশি। নারীদের অঙশগ্রহণ তেমন চোখে পরে না। তবে বুবন ব্যাবতীত অন্যান্য কাজে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মত। প্রতিটা জামদানিতে একাধিক তাঁতীর শ্রম থাকে।
জামদানি তৈরি
জামদানি তৈরির প্রদান কাঁচামাল সুতা সংগ্রহের পর প্রয়োজনীয় রং চাপাতে হয় নদীর পানিতে ভিজিয়ে। তারপর শুকিয়ে কাজ করার উপযোগী করা হয় এবং শুরু হয় বুননের কাজ। বর্তমান যুগে যন্ত্র চালিত মেশিনের ব্যবহারের প্রচলণ থাকলেও অরিজিনাল জামদানি প্রস্তুত করা হয় তাঁতীদের হাত ও পায়ের কাজের মাধ্যমে। এগুলো মানের দিক অন্ত্যান্ত মানসম্পন্ন এবং ব্যবহারে আরামদায়ক। জ্যামিতিক নকশায় ফুটিয়ে তোলা হয় নানা ধরণের ফুল, ফল, লতাপাতা সহ নানা ডিজাইন। সাধারণত ৭০-৮০ কাউন্টের সূতা ব্যবহৃত হয় জামদানি তৈরিতে। শাড়ির ডিজাইনের উপর নির্ভর করে ৭ দিন থেকে ৬ মাস তারও বেশি সময় লেগে থাকে কাজ সম্পন্ন হতে।
তাঁতীদের জামদানির বৈশিষ্ট
হাতে বোনা বা অরিজিনাল শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো- প্রথম ৫ হাত (যেটা কোমেরে গুজি দেওয়া হয়) পাড় থাকে না। উভয় পাশের ফিনিশিং প্রায় একই হওয়ায় পার্থক্য করার সুযোগ থাকে না। অন্যান্য শাড়ী তুলনায় জামদানি ওজনে হালকা তাই সতর্কতার সাথে যত্ন নিতে হয়। শাড়ী বা পাঞ্জাবী ব্যবহারে বটে না। সুতি, হাফসিল্ক এবং রেশম সুতায় তৈরি হয় জামদানী। একারণে তানার সুতা পুড়ালে গুটি না বাধবে ছাই হয়ে যায়।
জামদানির প্রকারভেদ
জামদানি শাড়ি সাধারণত তিন প্রকার- ১. পিউর কটন জামদানি কাপার্স তুলায় তৈরি হয়, ২. হাফ-সিল্ক জামদানির লম্বালম্বি তানার সুতাগুলো তুলা এবং আড়াআড়ি বাইনের সুতাগুলো রেশমের। ৩. ফুল-সিল্ক জামদানি যেখানে দুই প্রান্তের সূতাই রেশমের হয়ে থাকে। তবে ডিজাইনের উপর নির্ভর করে বহু প্রকারের হয়ে থাকে।
সম্ভাবনাময় মার্কেট
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম ফেসবুক গ্রুপের কল্যাণে প্রচুর নতুন নতুন ক্রেতা তৈরি হচ্ছে। যারা কখনই ই-কমার্সে কেনাকাটা করেনি তারাও জামদানি শাড়ি, পাঞ্জাবীর ক্রেতা হচ্ছেন উই গ্রুপে জামদানি সম্পর্কে জানাশুনার কারণে। এমনকি বিয়ে শাদীতেও জামদানির প্রচলন শুরু হচ্ছে। এ প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে ১ জন বিক্রেতা এবং একজন ক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়- জামদানি লাভার্সের প্রতিষ্ঠাতা জেসমিন সুলতানা মুক্তি বলেন গত ১ মাসে উই গ্রুপ থেকে ১ লাখ টাকার অধিক জামদানি বিক্রি হয়েছে। নূরুননবি হাসান বলেন- তার বিয়ের সকল শাড়ি আর পাঞ্জাবি জামদানির অর্ডার করেছেন।
কাকলী’স এটিয়্যার প্রতিষ্ঠাতা কাকলি রাসেল তালুকদার বলেন- জামদানী শাড়ির টেকসইতা, সৌন্দর্য্য এবং বুনন কাল নির্ভর করে আসলে সুতার কাউন্ট এর উপর। সুতার কাউন্ট শুরু হয় ২৬ থেকে ২০০+ কাউন্ট পর্যন্ত আছে। সুতার কাউন্ট যতো বেশি হবে, বুনন কাল ততো দীর্ঘ হবে, সৌন্দর্য্য ততো বৃদ্ধি পাবে এবং প্রাইস ততো বাড়বে। কারন সুতার কাউন্ট যতো বেশি হয়, শাড়িতে নকশা ততো সুক্ষ্মভাবে ফুটে।
জামদানির যত্ন
জামদানি তৈরিতে যেহেতু মাড় ব্যবহার করা হয়, তাই পানির ছোঁয়া ফেলে এলোমেলো হয়ে যায়। পানি থেকে দূরে থাকতে হবে। মাসের পর মাস ভাঁজ করে আলমারিতে ফেলে না রেখে মাঝে মাঝে ব্যবহার করে রৌদে শুকিয়ে ঠান্ডা করে যত্ন করে রাখতে হবে। হ্যাঙ্গারে বা ভাঁজ করে না রেখে রোল করে রাখা শ্রেয়। অন্যথায় ফেসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জামদানি ড্রাই ওয়াশ না করে কাঁটা ওয়াশ করিয়ে নিলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। শাড়িতে কোন প্রকার দাগ লাগলে ঘষাঘষি না করে টেলকম পাউডার ছড়িয়ে দিয়ে তারপর কাঁটা ওয়াশ করে নিতে হবে। নিচের পাড়ে পসপার লাগিয়ে নিতে হবে নতুবা ময়লা ও জুতার ঘষায় নষ্ট হতে পারে।