বাংলাদেশে শাড়িপ্রেমী নারীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে জামদানি শাড়ি। নান্দনিক ডিজাইন এবং দামে বেশি হওয়ার কারণে আভিজাত্য এবং রুচিশীলতা মানুষের জামদানি বেশি পছন্দ। বলা যায়, জামদানী শাড়ির প্রতি প্রতিটি নারীরই আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েছে। দেশের ২০০ বছরের ঐতিহ্য জামদানি নিয়ে বেশ কিছু দিন থেকে কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তা কাকলী রাসেল তালুকদার। টেকজুমের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি জানিয়েছেন জামদানী নিয়ে তার কার্যক্রম ও পরিকল্পনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. দেলোয়ার হোসেন।
টেকজুম : পেশা হিসেবে ই-কমার্সকে গ্রহণ করার কারণ?
কাকলী রাসেল তালুকদার : লেখাপড়া শেষ করে ই-কমার্স শিক্ষক হিসেবে ৫ বছর কর্মরত ছিলাম। তারপর আমি এক সন্তানের মা হই। তাকে দেখাশুনা করার জন্য ২ বছর বাসায় থাকতে হয়েছে। সন্তান দেখাশোনা এবং ঘরে বসে ক্যারিয়ার ডেভেলপ করতে ই-কমার্স বেছে নিয়েছি।
টেকজুম : বিশ্ব বাজারে তাকালে দেখা যায় উদ্যোক্তারা ওয়েবসাইট দিয়ে ব্যবসা শুরু করে কিন্তু আপনার শুরুটা হয়েছে ফেসবুক পেজ দিয়ে এর কারণ টা ব্যাখ্যা করবেন।
কাকলী রাসেল তালুকদার : আমাদের দেশে প্রায় সকলের ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে। কোন প্রকার টেকনিক্যাল জ্ঞান ছাড়াও ফেসবুক ব্যবহার করা যায়। ফেসবুকের মাধ্যমে খুব সহজে টার্গেট কাস্টমারের কাছে পৌঁছান যায়। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন যে আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যে পরিমাণ সময় ফেসবুক ব্যবহার করে তার চার ভাগের একভাগ সময়ও সে অন্য ওয়েবসাইটে ব্যবহার করে না। তাছাড়াও ফেসবুক দিয়ে শুরু করতে তেমন বাজেটের প্রয়োজন হয় না। সবদিক বিবেচনা করে বিজনেসের শুরুতে ফেসবুক পেজকে গুরুত্ব দিয়েছি।
টেকজুম : আপনার পেজের নাম “কাকলী’স এটিয়্যার” । কিন্তু আপনার কাস্টমারের কাছে পরিচিত হচ্ছেন উই গ্রুপের মাধ্যমে। এর পিছনে কারণ কি?
কাকলী রাসেল তালুকদার : আমার পেজের পাশাপাশি গ্রুপও আছে। আমার যখন বিজনেস ছিল না তখন আমি বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপে ঘুরাঘুরি করতাম এবং দেখতাম পেজ গুলো একরে পর এক সেলস পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে আর লাইভ শেয়ার করছে। কাস্টমার এবং সেলারের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে না। জানাশোনা হচ্ছে না। তখন পেজ এগুলোকে এড়িয়ে যেতাম। কোনটা অথেন্টিক পেজ বা কারা পণ্য সম্পর্কে ভালো বুঝেন কিছুই জানতে পারতাম না। আবার কার থেকে পণ্য ক্রয় করতাম কিছুই জানতাম না। সে কারণেই আমি ব্যতীক্রম খুজতে ছিলাম। যেখানে কাস্টমার এবং সেলারের মাঝে সুসম্পর্ক থাকবে। পণ্য সম্পর্কে জানতে পারবে। এটা একমাত্র উইতে পেয়েছি। এখানে কেউ পণ্য সম্পর্কে জানাতে পেরে উপকৃত হচ্ছে আবার কেউ তাদের পণ্য সম্পর্কে জানতে পেরে উকৃত হচ্ছে। উইতে কোন লাইভ শেয়ার নাই। সেলস পোস্ট নাই। তাই আমি এখানে নিয়মিত সময় দিচ্ছি।
টেকজুম : উই গ্রুপে সময় দেওয়ার আগে এবং পরে আপনার ব্যবসার অবস্থা কি?
কাকলী রাসেল তালুকদার : অনলাইন বিজনেসে আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। উইতে যুক্ত হবার আগে পরিচিত আত্মীয়-স্বজন আমার থেকে জামদানি অর্ডার করতো। উইতে সক্রিয় হবার পর গ্রুপে সকল সদস্যদের জামদানি সম্পর্কে জানাতে পারছি। অন্যদিকে রাজিব আহমেদ স্যার যখন জামদানি নিয়ে উই গ্রুপে পোস্ট দেয় তখন সব সদস্যদের মাথায় ঢুকে যায় এবং আস্থা নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকে না। এখন মানুষ আমার পোস্ট দেখে বা প্রোফাইল ঘেটে জামদানি অর্ডার দিচ্ছে। কাউকে বলতে হচ্ছে না অর্ডার দেন। সেলস পোস্ট না দিয়েও কিন্তু বিক্রি হচ্ছে বরং বিক্রি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
টেকজুম : ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের বুস্ট করা টাই মনে হয় প্রথম চিন্তা কিন্তু আপনি বুস্ট এড়িয়ে চলেন তার কারণ জানতে চাই।
কাকলী রাসেল তালুকদার : আমি শুরু থেকেই চেয়েছি আমার পেজটা অর্গানিক ভাবে বড় হোক। বুস্ট করে লাইক কমেন্ট বাড়ানো যাবে কিন্তু অথেন্টিক ক্রেতা যে বৃদ্ধি পাবে তার কোন গ্যারান্টি নাই। উইতে জামদানি নিয়ে নিয়মিত পোস্ট কমেন্ট করার কারণে ফ্রি মার্কেটিং হয়ে যাচ্ছে এবং কাস্টমার তৈরি হচ্ছে। এখন কাস্টমাররাই নিয়মিত পোস্ট দেয় জামদানি নিয়ে।
টেকজুম : ক্রেতাদের নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
কাকলী রাসেল তালুকদার : আমি চাই আমার কাছে থেকে পণ্য কেনার পরে ক্রেতা আবার আসুক । সবাই যে কাস্টমার হবে তা নয়। অনেকে তথ্য ও পরামর্শের জন্যেও আসে। আমি তাদের আমার সাধ্যমতো পরামর্শ দেবার চেষ্টা করি। আর উই গ্রুপে স্যার সহ অন্যান্যরা বার বার পোস্ট দেওয়ায় নতুন কাস্টমারদের মাথায় জামদানি ঢুকে গেছে। নিজেরাই পেজ ভিজিট করে বা আমাকে খোঁজ করেন প্রয়োজনে বা শখের বসে জামদানি কিনছেন।
টেকজুম : নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
কাকলী রাসেল তালুকদার : যারা ব্যবসা শুরু করছে তাদেরকে বলব প্রতিনিয়ত জানার চেষ্টা করতে এবং কাস্টমারদের জানাতে। তারা যত বেশি কাস্টমারদের জানাবেন তত বেশি কাস্টমার তৈরি হবে। আর যারা ব্যবসা শুরু করতে ইচ্ছুক তাদের খুঁজে বের করতে হবে, কোন পণ্যের প্রতি তার বেশি আগ্রহ রয়েছে এবং প্রোডাক্ট সোর্সিং সহজে করা যাবে। এমন নয় যে একটা পণ্য এখন অনলাইনে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে সেটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে হবে। ব্যবসা শুরু করার আগে অন্তত ৬ মাস পড়াশোনা করতে হবে।
ফেসবুকের মাধ্যমে দেশি পণ্যের প্রচারে ই-কমার্স অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ বলেন, “ ই-কমার্স কাস্টমার একদিনে তৈরি হয় না। যদি এমনটাই হতো তাহলে সবাই একটা করে পেজ বা গ্রুপ করে শুধু লিংক শেয়ার আর লাইভ করে যেতো। এভাবে কিন্তু ১% সেলসও হয় না। পণ্য নিয়ে যত বেশি পোস্ট কমেন্টের মাধ্যমে আলোচনা হবে তত বেশি মানুষের মাথায় ঢুকে যাবে।“
তিনি আরও বলেন, “ দেশি পণ্যের জন্য উইমেন এন্ড ই-কমার্স (উই) গ্রুপ সেরা প্লাটফর্ম। আমরা গত ১৫ দিন আগে বিয়ের ছবির একটা ঢেউ তোলেছি। সেখানে সাধারণ সদস্যরা তাদের বিয়ের ১ হাজারের অধিক ছবি শেয়ার করেছে। কাউকে বলা হয়নি কেনাকাটা করতে। এতে করে আস্থা জায়গা তৈরি হয়েছে। এটাই ফেসবুকের শক্তি। যারাই দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের উচিত প্রচুর পরিমাণে পণ্য সম্পর্কে পোস্ট করা। তাহলে সেলস এমনিতেই বেড়ে যাবে।