বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ ফলে মৎস্যজাত খাদ্যের উৎসের প্রায় অধিকাংশই নদীর সাথে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত।আমাদের এই অঞ্চলের প্রায় ৭.৩ মিলিয়ন লোকের জীবিকা সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর নির্ভরশীল। বছরে প্রায় ৫.৪৬ লক্ষ মেট্রিক টন মৎস্য আহরিত হয় সমুদ্র থেকে যার ২০% শুটকি হিসাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।বাংলাদেশ থেকে (২০১১-১২)অর্থ বছরে প্রায় ৬২৩ মেট্রিক টন শুটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশে ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুটকি তৈরি হয়।প্রজাতিভেদে প্রায় ৩-৫ কেজি কাঁচা মাছ প্রয়োজন হয় প্রতি কেজি শুটকি তৈরিতে। বছরের অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে শুটকি শুকানো হয় অর্থাৎ শীতকালকে শুটকির প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় হিসেবে ধরা হয়।বাংলাদেশের উৎপাদিত সামুদ্রিক শুটকির সবচেয়ে বড় অংশই তৈরী হয় কক্সবাজারে।
বাংলাদেশের শুটকির বড় অংশ উৎপাদিত হয় চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলায়।বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শুটকির জন্য বিখ্যাত এতো সবার জানা কথা।চট্টগ্রামের শুটকি নিয়ে অন্যান্য জেলাতেও বেশ সুনাম রয়েছে। সারিবদ্ধভাবে ভাবে শুটকি শুকাতে দেখা যায় শহরের কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে।কর্ণফুলী ছাড়াও চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ সংগ্রহ করে শুটকি বানানো হয়ে থাকে। কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষা বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট ও জুলধায় গড়ে উঠেছে এ খাতের বিভিন্ন পল্লী গুলো। বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকার গভীর সমুদ্র থেকে জেলেদের সংগ্রহ করা মাছ কর্ণফুলীর তীরে আনা হয়।শ্রমিকের সহজলভ্যতা এবং নৌপথ যোগাযোগের সুবিধার ভূমিকা রয়েছে এতে।
এছাড়া কক্সবাজার, মহেশখালী, মাইশদিয়া, কুতুবদিয়া, কর্ণফুলী, চরচাক্তাই, রাঙাবালি অঞ্চলে শুটকি উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত হয়ে থাকে। চট্টগ্রামের চরচাক্তাই বাজার হচ্ছে শুটকির প্রধান আড়ৎ।এখানে বিশাল একটি শুটকিপল্লীও রয়েছে।মুলত অক্টোবর মাসের শুরু থেকে এখানে শুটকি উৎপাদন শুরু হয়ে যায় এবং নভেম্বরে শীতের শুরু থেকে পুরোদমে শুটকি উৎপাদনে নেমে যায় জেলে সম্প্রদায়।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এলাকাকে শুটকির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বলা হয়ে থাকে। এখানে নানান ধরণের শুটকি মাছ সহজপ্রাপ্য এবং এখানকার শুটকি বিদেশের মাটিতেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছে।এখানকার শুটকি মাছ আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। মানভেদে এই শুটকিকে তিনটি গ্রেডে ভাগ করা হয়; এ, বি এবং সি। বিদেশে “এ” গ্রেডের শুটকির চাহিদা বেশি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন শহরের শুটকি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে মানসম্মত শুটকি সংগ্রহ করতে আসেন এবং তা খুচরা বাজারে বিক্রি করে থাকেন।
লইট্যা, পোয়া মাছ, ছুরি মাছ, চিংড়ি মাছ, মইল্যা মাছ, রুপচাঁদা মাছ, ফাইস্যা মাছ, ছোট হাঙ্গর মাছ আরও নানা প্রজাতির মাছ শুকানো হয় কর্ণফুলি নদীর পাড়ে। জানা যায়, এসব মাছ ১৫-২০ দিন সময় নিয়ে শুকাতে হয়।এসব শুটকি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করার পর বিদেশে ব্যাপক চাহিদা মেটাতে রপ্তানিও করা হয়। আরো জানা যায় যে, শীতের দিনে চরম রোদের মাঝে শুটকি বেশী শুকানো হয় এবং বিকিকিনি ভালো হয়। অন্যান্য ঋতু বিশেষত বর্ষার সময় তেমন কেনাবেচা থাকে না কারণ তখন মাছের সংকট থাকে।এছাড়া বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে বৃষ্টি ও সতর্ক সংকেত থাকলে মাছ শিকার বাধাগ্রস্ত হয়।পাশাপাশি রোদের অপ্রতুলতা তো রয়েছেই।
বাশঁখালী, মহেশখালী, কক্সবাজার, কাপ্তাই থেকে শীতের মৌসুমে প্রচুর মাছ চট্টগ্রামে আসে এবং সব মাছ শুকিয়ে বিভিন্ন আড়ৎদারের কাছে সঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়া হয়।শুটকির মধ্যে সবচেয়ে দামী হলো লাক্কা ও রূপচাঁদা।অত্যন্ত মজাদার এবং উৎপাদন খরচের কারণে এগুলোর দাম বেশি বলে ব্যবসায়ীরা জানান। ছুরি শুটকিরও দাম বেশ ভালোই।কম দামের শুটকি হলো মিশালী শুটকি। তবে জানা যায় লইট্ট্যা শুটকির চাহিদা বেশি।
শুটকিপল্লীতে প্রতিদিন কাজ করেন শত শত নারী-পুরুষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হলেও পারিশ্রমিক নিয়ে সন্তুষ্ট নন কর্মীরা।বর্তমান ই-কমার্সের যুগে সবকিছুই প্রায় অনলাইনে কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন কর্মব্যস্ত মানুষ।
ফলে শুটকির মতো দেশিপণ্য ই-কমার্সের কল্যাণে যদি অনলাইন ভিত্তিক শপ গুলোতে পাওয়া যায় তাহলে এটির চাহিদা যেমন বাড়বে তেমনি পারিশ্রমিক বাড়বে শ্রমিকদের। তাছাড়া এটি সম্ভাবনাময় একটি খাত ফলে উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এটির প্রসার নিশ্চিত করা গেলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারে দেশ।চট্টগ্রামের বিখ্যাত এই শুটকির বাজার আরো প্রচারণা পাবে ই-কমার্সের কল্যাণে এবং সুদিন আসবে এই খাতের পাশাপাশি হাসি ফুটবে এখানকার শ্রমিকদের মুখে এটি এখন কেবল সময়ের দাবি।