১৯ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের কয়েকজন দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও নিউজ পোর্টাল টেকজুম ডটটিভি মিলে শহরের গ্রীন পার্ক রেস্টুরেন্টে ”ময়মনসিংহ ই-কমার্স এর সমস্যা ও সম্ভাবনা” শীর্ষক আলোচনা বৈঠক আয়োজন করেছে। আলোচনা শুরু হয় সকাল ১১ টায়। স্বগাত বক্তব্য দেন খাতুনে জান্নাত আশা এবং বৈঠকের উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেন রাজিব আহমেদ। অনুষ্ঠানের নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
বিশেষজ্ঞ আলোচকগণ –
- ইকরামুল হক টিটু: মেয়র, ময়মনসিংহ সিটি কার্পোরেশন, ময়মনসিংহ।
- ডাঃ মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম : বিভাগীয় প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ।
- ডাঃ মোঃ কামরুজ্জামান : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ।
- রাজিব আহমেদ : প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি, ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)।
- ওয়াশিকুর রহমান শাহিন : সম্পাদক টেকজুম ডটটিভি।
- মোঃ দেলোয়ার হোসেন : প্রতিষ্ঠাতা আওয়ার শেরপুর ও প্রতিনিধি, টেকজুম।
- ধন্যবাদ জ্ঞাপন: আরিফা খাতুন, স্বত্বাধিকারী আফাফ ক্রিয়েশন ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রতিনিধি, টেকজুম।
- সঞ্চালনা: খাতুনে জান্নাত আশা, স্বত্বাধিকারী, পিয়াসী ও ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম।
ইকরামুল হক টিটু : আগের তুনলনায় ই-কমার্স সেক্টরে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। একযুগ আগেও ময়মনসিংহে নারী উদ্যোক্তা খুজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। ই-কমার্সের কারণে এখন চিত্র পাল্টেছে। ই-কমার্স না থাকলে করোনা কালীন সময়ে ঘরে বসে সেবা পাওয়া দুষ্কর ছিল। অনেকের চাকরি বা ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় পুজিঁ নষ্ট করে চলতে হতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় মহোদয়ের পরামর্শে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বছর পূর্বে প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার নির্বচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছেন। এরফলে ই-কমার্স সহ অন্যান্য আধুনিক সেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছি। ই-কমার্স উদ্যোক্তারা নিজের অবস্থান মেলে ধরার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। গোল টেবিল আলোচনার ফলে ময়মনসিংহের ই-কমার্সের চ্যালেঞ্জ গুলো জেনে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে এগিয়ে নেওয়া যাবে। এতে ময়মনসিংহের ই-কমার্স দ্রুত বড় হওয়ার ব্যাপক সম্ভবানা রয়েছে। হুজুগে ই-কমার্স উদ্যোক্তা না হওয়ার পরামর্শ দেন টিটু।
ডাঃ মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম : নারীরা আজকের দিনে আর পিছিয়ে নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীদের এগিয়ে যেতে প্রতিনিয়ত উৎসাহ প্রদান করছে। ই-কমার্সে ক্যান্সার প্রতিরোধক শুকনো পাটশাক, আয়রন সমৃদ্ধ বিনা ধান, নকশীকাঁথা, মাশরুম সহ অন্যান্য পণ্যের সম্ভাব্য বাজার তুলে ধরেন। এসব পণ্যের ব্র্যান্ডিং গুরুত্ব ও সহজলভ্যতার সম্ভাবনাও তুলে ধরেন। আস্থা অর্জনে সিগনেচার পণ্যের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন। বিনা থেকে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ, বীজ বিতরণ সহ অন্যান্য সুবিধার কথা উল্লেখ করেন। অর্গানিক কৃষি পণ্যের বাজার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সঠিক প্রচার আর সিরিয়াস ভাবে উদ্যোক্তারা লেগে থাকলে দেশের কৃষি মার্কেটে ময়মনসিংহের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা এগিয়ে থাকবে।
ডাঃ মোঃ কামরুজ্জামান : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাণী- ’প্রতিটা গ্রাম হবে শহর’ বাস্তবায়ন করতে ই-কমার্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ই-কমার্সে ভোগান্তিহীন কেনাকাটা করা যায়। তাই বর্তমানে মানুষ বাহিরে গিয়ে কেনাকাটাকে ভোগান্তি আর সময় অপচয় মনে করে। এটি ই-কমার্সের জন্য বিশাল সম্ভাবনা। অর্গানিক কৃষি বাজারের আকার এবং সম্ভাবনাও তুলে ধরেছেন বৈঠকে। তিনি উদ্যোক্তাদের তিনটি বিষয়ে সতর্ক করেন- টাইম, কসট, ভিজিটিং।
রাজিব আহমেদ : সেই ২০১৪ সাল থেকে বলে আসছি যে ডিজিটাল বাংলাদেশ এর সুফল ঘরে ঘরে পৌছাতে হলে ই-কমার্সকে এগিয়ে নিতে হবে। কৃষি সমৃদ্ধ ময়মনসিংহ বিভাগে অনেক আগে থেকেই ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাই এই অঞ্চলে কৃষি ভিত্তিক স্টার্টআপ তৈরির সম্ভবানা রয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে পণ্য ডেলিভারি সমস্যা নিরসনে বড় কুরিয়ার সার্ভিস গুলো চেষ্টা করতেছে। এবছরের মধ্যে প্রতিটি গ্রামে না হোক প্রতিটি ইউনিয়নে ই-কমার্সকে নিয়ে যেতে হবে। কৃষি পণ্য, হোটেল, দর্শনীয় স্থান সহ সম্ভাব্য খাত গুলো এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তারা মিলে মাসে অন্তত একটি রিপোর্ট করার চেষ্টা করতে হবে।
ওয়াশিকুর রহমান শাহিন : বিভাগীয় ই-কমার্স কে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের ঐক্যবদ্ধতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডেলিভারির মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাও সমাধান করা সম্ভব হবে যদি উদ্যোক্তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে। মানুষে বহু রকমের চাহিদা পূরণ করতে ভিন্ন ভিন্ন প্রোডাক্ট ও সার্ভিসে উদ্যোগ প্রয়োজন।
মোঃ দেলোয়ার হোসেন: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, আনন্দমোহন কলেজ সহ অনেক গুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ময়মনসিংহে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার পোস্ট গ্রাজুয়েট বের হয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। তাদের কে ই-কমার্সের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলে বেকারত্ব হ্রাস পাবে। এছাড়াও ময়মনসিংহে প্রায় সোয়া কোটি মানুষের বসবাস। এখন উপযুক্ত সময় তাদেরকে ই-কমার্সে উদ্বুদ্ধ করার। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব কম হওয়ায় জেলায় উৎপাদিত পাট পণ্য, মাছ, মন্ডা সহ কৃষি পণ্য সারাদেশে দ্রুত পৌছে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ময়মনসিংহের ই-কমার্স কে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পণ্যের কনটেন্ট বাড়াতে হবে এবং আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। বিনা, সিটি কার্পোরেশন, চেম্বার অব কমার্স সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গুলো আগ্রহ ময়মনসিংহের ই-কমার্সের প্রেরণা। বকৃষি থাকায় কৃষি ভিত্তিক স্টার্টআপ ও বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খাতুনে জান্নাত আশা : ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রী প্রতিষ্ঠায় অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ’শিক্ষা নগরী’ হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহের ই-কমার্স সেক্টরে শিক্ষিত লোকদের এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে, শিক্ষিত উদ্যোক্তা তৈরীর সম্ভাবনা রয়েছে, যারা ভালো মানের কন্টেন্ট তৈরী করে অঞ্চলভিত্তিক পন্যগুলোকে উঠিয়ে আনতে পারে। ময়মনসিংহে কৃষি গবেষনা ইন্সটিটিউট থাকায় এবং এখানের গবেষকরা উদ্যোক্তাদের গবেষণায় সাহায্যের করবে। এরফলে হারিয়ে যাওয়া কৃষিপণ্য গুলো পুনরুদ্ধার এবং নতুন পণ্য প্রচার প্রসার হবে। ই-কমার্সে মৃতশিল্পেও ব্যাপক সম্ভাবনা দেখেন। ডেলিভারি সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান প্রত্যাশা করেন।
ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের মধ্যে আলোচক ছিলেন-
- রোকসানা আক্তার : স্বত্বাধিকারী, মাটির ফুল অর্গানিক।
- শামিমা নাসরিন ঋতু : স্বত্বাধিকারী, ৭ ঋতু।
- ফাতেমা-তুজ-জোহুরা : স্বত্বাধিকারী, সারমায়া ফ্যাশন হাউজ।
- ফারজিনা আক্তার রুমা : স্বত্বাধিকারী, মা ও মেয়ের বুটিক।
- ফাতেমা খাতুন তিথি : স্বত্বাধিকারী, দোলনচাঁপা।
- রোখসানা আক্তার পপি : স্বত্বাধিকারী, ইপ্পি শপিং।
- কুয়াশা কামরুন্নাহার : স্বত্বাধিকারী , কুয়াশা হস্তশিল্প জামালপুর।
রোকসানা আক্তার : “ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় প্রচুর আখ উৎপাদন হয়। ই-কমার্সে হাতে তৈরী ব্রাউন চিনির রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।”
শামিমা নাসরিন ঋতু : মায়মনসিংহে বিপুল পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়। পাটের ফাইবার থেকে পোশাক, পাটকাঠি থেকে পারটেক্স বোর্ড, চারকোল, ঘর সাজানোর সৌখিন সামগ্রী, পাটের চা ইত্যাদি উৎপাদন হয়। ই-কমার্সের মাধ্যমে এসবের প্রচর প্রসার বাড়ানো সম্ভব। ঋতু আরও বলেন, পাটজাত পণ্যের কাচামাল সংগ্রহ ও প্রক্রিজাত করে ক্রেতার কাছে পৌছাতে মোটামুটি বিনিয়োগ লাগে। অর্থ জোগাড় করা উদ্যোক্তাদের জন্য একটু কঠিন হয়ে উঠে।
ফাতেমা-তুজ-জোহুরা : কুরিয়ার জটিলতা ও ব্যয় দেশের ই-কমার্স প্রসারে উল্লেখযোগ্য বাধা। কুরিয়ার সেবা আরও দ্রুত ও খরচ কমাতে পারলে দ্রুত বড় হবে ই-কমার্স সেক্টর।
ফারজিনা আক্তার রুমা : নতুন সেক্টরের সাথে কাস্টমারদের খাপ খাওয়াতে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং নিয়মিত আপডেট হতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত কাস্টমার এনালাইসিস করতে হবে তাদের চাহিদা বুঝার জন্য।
ফাতেমা খাতুন তিথি : ই-কমার্স সেক্টর নতুন হওয়ায় অন্যের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সিজনাল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয় এবং হোঁচট খেয়ে থেমে যায়। এতে মার্কেট নষ্ট হয় এবং ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হয় এসব উদ্যোক্তারা। এ সমস্যা দূর করতে ই-কমার্স সম্পর্কিত লেখাপড়া বাড়াতে হবে।
রোখসানা আক্তার পপি : ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাহালগাঁ গ্রামে অর্কিড চাষ হয়। সারাদেশে সৌখিন মানুষের চাহিদা মেটাতে ই-কমার্স সবচেয় বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে। পপি আরও বলেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষ ই-কমার্স সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদেরকে ই-কমার্সে সম্পৃক্ত করতে প্রচারণার প্রয়োজন। আমাদের সিংহভাগ সম্ভাব্য কাস্টমার গ্রামে বাস করে তাই গ্রাম পর্যায়ে ডেলিভারি নিশ্চিত করতে পারলে দ্রুত বড় হবে ই-কমার্স খাত।
কুয়াশা কামরুন্নাহার : তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি হয় জামালপুরের হস্ত পণ্য। এর ফলে শ্রমীকরা পর্যাপ্ত মুজুরি না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করতেছে। যদি সরাসরি ই-কমার্সের মাধ্যমে শতভাগ বিক্রি নিশ্চিত করা যায় তাহলে এসমস্যা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, জামালপুরে প্রচুর বেনেনা ফাইভার এবং পাইনাপেল ফাইভার উৎপন হয়। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এসব কাচামাল কাজে লাগানো যাবে এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে সহজে বিক্রি করা যাবে।
আরিফা খাতুন : যেসব উদ্যোক্তারা শিখে মাঠে আসবে তারা দ্রুত এগিয়ে যাবে। যারা শেখার ক্ষেত্রে অলসতা করবে তারা জড়ে যাবে। ময়মনসিংহের উদ্যোক্তাদের ঐক্যতা ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি কে বড় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কৃষি ও মৎস্য সেক্টরকে সম্ভাবনার চোখে দেখেন আরিফা খাতুন। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সকল অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানায়।