ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করবে সরকার। একই সঙ্গে খাতটির সুষ্ঠু পরিচালনায় ডিজিটাল ই-কমার্স অ্যাক্ট নামে একটি স্বতন্ত্র আইন করা হবে। আজই এসব বিষয়ে কাজ শুরু করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ই-কমার্স ব্যবসায় সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা ও এ-বিষয়ক নীতিনির্ধারণী সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। সভায় উপস্থিত থেকে মতামত দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
এছাড়া বৈঠকে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি অনুবিভাগ) এএসএম সফিকুজ্জামান, ডিজিটাল ই-কমার্স সেলপ্রধান ও ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. হাফিজুর রহমান, উপসচিব মোহাম্মদ সাঈদ আলীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে আলোচনার বিভিন্ন বিষয় এবং এ থেকে উঠে আসা সুপারিশ সম্পর্কে ব্রিফিং দেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। এ সময় ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
ব্রিফিংয়ে বাণিজ্য সচিব জানান, সভায় ই-কমার্স খাতে যে প্রতারণা ঘটেছে তার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেয়া যায় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে করণীয় কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনায় অংশীজনদের থেকে কেউ কেউ বলেছেন ই-কমার্স খাত বন্ধ করে দিতে। তবে সর্বসম্মতভাবে আলোচনায় তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কারণ দেশের ই-কমার্স খাতে এখন তৈরি হয়েছে ক্রমবর্ধমান ও সীমাহীন সম্ভাবনা। ১০-১২টি প্রতিষ্ঠানের জন্য লাখ লাখ উদ্যোক্তা এর দায় বহন করবে কেন?
সচিব জানান, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক যে গত ৪ জুলাই ই-কমার্স খাতের জন্য যে পরিচালন নির্দেশিকা জারি হয়েছে তার পর থেকে এ ধরনের প্রতারণা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখন যে ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা পরিচালন নির্দেশিকা জারি হওয়ার আগেই ঘটে গেছে।
তপন কান্তি ঘোষ জানান, সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু পরিচালনায় একটি আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা রেগুলেটরি বডি গঠন করা হবে। ভবিষ্যৎ প্রতারণা বন্ধে এবং প্রতারণা সংঘটিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিজিটাল ই-কমার্স অ্যাক্ট নামে একটি স্বতন্ত্র আইন করা হবে।
এছাড়া ই-কমার্স ব্যবসার বিভিন্ন দিক থেকে আসা অভিযোগ গ্রহণ ও আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ব্যবস্থাপনা রাখা বা সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দাঁড় করানো হবে।
এরই মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিষয়ে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ এসেছে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ই-কমার্স খাতের সঙ্গে এ দুটো আইনের সামঞ্জস্য রাখতে আইনের কয়েকটি জায়গায় সংশোধনী আনতে হবে, যার কাজ শিগগিরই শুরু করা হবে। এছাড়া নিবন্ধন ছাড়া কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এখন থেকে আর ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশে এর আগে যুবক, ডেসটিনিতে যে প্রতারণা ঘটেছে, ই-কমার্স খাতে সংঘটিত ঘটনাগুলো এক রকম নয়। কারণ যুবক-ডেসটিনির পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল। ওইসব সম্পদের বিক্রয়মূল্য এখন অনেক বেড়েছে। তা দিয়ে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধের একটি সুরাহা হতে পারে। এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি একটি পর্যালোচনা করে দেখছে। সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় আইনি দিকগুলো খতিয়ে দেখছে।
ইভ্যালির বিষয়ে টিপু মুনশি বলেন, তাদের প্রপার্টি বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ইভ্যালির রাসেল জেলে আছেন। আমরা তার সম্পদের হিসাব দেখব। যদি দেখি তাকে বের করা গেলে তার সম্পদ বিক্রি করে কিছু টাকা ফেরতের ব্যবস্থা হয়, তাহলে সেই আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, মনে হচ্ছে তারা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না। কারণ হয় ইভ্যালি টাকা সরিয়ে নিয়েছে, না হয় বিজ্ঞাপনের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করেছে। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন জায়গায় স্পনসর করেছে। এখন তাদের কাছে মনে হয় টাকা নেই। তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার সুযোগও নেই।
ই-কমার্সের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, গত ৪ জুলাই যে নীতিমালা চালু হয়েছে—বিশেষ করে এসক্রো সিস্টেম চালু হয়েছে—এখন কিন্তু কোনো কোম্পানি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারছে না। এখন আর চিট করার কোনো সুযোগ থাকছে না। আমরা একটা হিসাব পেয়েছি। গত জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ৬ হাজার কোটি টাকার মতো বেচাকেনা হয়েছে ই-কমার্সে। আর নীতিমালা চালুর পর ৪০০ কোটি টাকার অর্ডার পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অর্ডার এসক্রো সিস্টেমের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে।
ইভ্যালির রাসেলকে মুক্তি দেয়া হবে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এখন তার হাত যদি শূন্য হয়, যদি তার কাছে গ্রাহককে ফেরত দেয়ার মতো কোনো টাকা না থাকে তাহলে তাকে মুক্তি দিয়ে মুক্ত বাতাসে ঘুরতে দিয়ে লাভ কী। আর যদি দেখা যায় তার সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা ফেরত দেয়া যাবে, তাহলে মুক্তির বিষয়টি আইন বিবেচনা করবে।