আমাদের মাতৃভূমি বেলে, এঁটেল ও দোআঁশ মাটির হওয়ার কারণে এবং উপযুক্ত আবহাওয়ার প্রভাবে বহুকাল ধরে বৈচিত্রময় শতশত পণ্য উৎপাদন হয়ে আসছে। অধিকাংশ পণ্যের রয়েছে নিজস্বতা। একই পণ্য একাধিক জেলায় উৎপাদন হলেও প্রায় সময় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এসব স্বতন্ত্র পণ্যের স্বীকৃতি ও আঞ্চলিক পরিচিতি সর্বত্র বাড়াতে বিশ্বব্যাপী প্রচলন শুরু হয়েছে ’জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই)’ স্বীকৃতি। বাংলাতে এটিকে বলা হয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। যেটি একটি ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ঢাকাই জামদানি, রাজশাহীর সিল্ক, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, রংপুরের শতরঞ্জি ইত্যাদি।
জিআই পণ্য কী?
জিআই মূলত একটি স্বীকৃতি ও সনদের নাম। মাটি, পানি, আবহাওয়া কিংবা কারিগরের বিশেষ দক্ষতায় অনন্য হওয়া পণ্যগুলো জিআই স্বীকৃতি পেতে শিল্পমন্ত্রণালয়ের আওতায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)-এর কাছে আবেদন করে। মূলত কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ পণ্যকে চিহ্নিত ও পরিচিত করতে জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যেন স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে এবং ঐ অঞ্চলের পরিচিতি পায়। সে সাথে নামের উপর ভিত্তি করে ক্রেতারা পণ্যটি কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জিআই স্বীকৃতি কেন দরকার?
একটি বিশেষ পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেন কোনো পণ্যের বিস্তারিত না জানলেও খ্যাতির উপর নির্ভর করে সেই পণ্যটি ব্যবহার করতে পারে ভোক্তারা। এছাড়াও এটি ভৌগোলিক পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নে অবদান রাখে। সাধারণত উৎপত্তিস্থলের নামে দেওয়া হয় জিআই স্বীকৃতি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ঢাকাই জামদানি, রাজশাহী সিল্ক, দিনাজপুর কাটারীভোগ চাল, রংপুরের শতরঞ্জি কিংবা বাংলাদেশের ইলিশ মাছের কথা।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে জিআই স্বীকৃতি গুরুত্ব বহন করে। এছাড়াও রপ্তানিতে বিশেষ অবদান রাখে এই স্বীকৃতি। জিআই সনদ পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য কোন দেশ সরাসরি ’ইলিশ মাছ’ কিংবা ’জামদানি শাড়ি’ নামে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে না। এই দুটি পণ্য পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপাদন হলেও বাংলাদেশের পণ্যগুলোর সাথে শতভাগ বৈশিষ্ট্যে মিলবে না। এ যুক্তির দলিলই জিআই স্বীকৃতি। এর ফলে রপ্তানির পুরো লভ্যাংশ একক ভাবে ভোগ করে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া দেশ।
পাশের দেশ ভারতও জামদানি পণ্যের জিআই সনদ পেয়েছে। ভারতের জামদানির নাম ’উপধা জামদানি শাড়ি’ আর বাংলাদেশের ’জামদানি শাড়ি’। ভারতের ’ফজলি আম’ এবং বাংলাদেশের ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’। একই পণ্য উভয় দেশে হলেও বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য রয়েছে।
বাংলাদেশের ১১ জিআই পণ্য।
২০১৬ সালের গোড়ার দিকে ঢাকাই জামদানি জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকতা পেয়েছে। এরপর হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত আরও ১০টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের মোট ১১টি জিআই পণ্যের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিচে দেওয়া হলো-
- ঢাকাই জামদানি: কয়েক শতাব্দি ধরে শীতলক্ষ্যা নদীর অববাহিকায় তাঁতিরা সুনিপুন দক্ষতায় বুনন করছেন জামদানি শাড়ি। যা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। ব্রিটিশ আমলে যে কয়টি পণ্যের মাধ্যমে ঢাকা বৈদেশি মুদ্রায় আয় করেছে তার একটি জামদানি। রাজা-সম্রাটসহ রুচিশীল ও অভিজাত মানুষের পছেন্দ পছন্দের পোশাক ঢাকাই জামদানি। এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপাদন হয় না জামদানি শাড়ি। তাই এই পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পেতে ২০১৫ সালে আবেদন করা হয় এবং ২০১৬ সালে দেশের প্রথম জিআই পণ্যের মর্যাদা লাভ করে।
- বাংলাদেশের ইলিশ: বাংলাদেশের জাতীয় মাছের নাম ইলিশ। পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকার প্রধান প্রধান নদ-নদীতে উৎপাদন হয়। দেশের প্রায় ১০০টি নদ-নদীতে সারা বছর ইলিশ পাওয়া যায়। হাজার হাজার মানুষের জীবীকা নির্বাহ হয় ইলিশকে কেন্দ্র করে। দেশের মৎস্য উৎপাদনের ১০% অবদান ইলিশের। বাংলাদেশের ইলিশের স্বাদ আর কোথাও পাওয়া যায় না। ২০১৭ সালে দেশের দ্বিতীয় জিআই পণ্য হিসেবে নতুন পরিচয় তৈরি হয় বাংলাদেশের ইলিশের।
- খিরসাপাত আম: চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি উৎকৃষ্ট জাতের নাম খিরসাপাত আম। বাণিজ্যিক ভাবে এটি খুবই জনপ্রিয় জাত। শাসে আঁশবিহীন, রসাল, গন্ধ আকর্ষণীয় ও বেশ মিষ্টি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দেশের তৃতীয় জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
- ঢাকাই মসলিন: এটি ছিল আভিজাত্যের পোশাক। ইতিহাস থেকে জানা যায় মসলিন কাপড়ের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের। মসলিনের বিকাশ লাভ করেছিল ১৭ শতকের দিকে। মসলিন কাপড় শতভাগ সুতি, মসৃণ, পাতলা স্বচ্ছ ও ওজনে হালকা। শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় বিশেষ ভাবে উপযোগী। আবহাওয়ার কারণে ঢাকার আশেপাশে ব্যতীত পৃথিবীর আর কোথাও তৈরি হয় না এমন মসলিন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিন নামে দেশের ৪র্থ জিআই পণ্যের মর্যাদা লাভ করেছে।
- রাজশাহী সিল্ক: প্রাচীনকাল থেকে রাজশাহী অঞ্চলে রেশম (সিল্ক) চাষ হয়ে আসছে। তা থেকে তৈরি হয় উন্নতমানের রেশম পোশাক। চাকচিক্য ও উজ্জ্বলতার কারণে রাজশাহী সিল্ক দেশ বিদেশে অতুলনীয়। বিশ্ববাজারে সিল্কের কদরও অসীম। এটি দেশের ৫ম জিআই পণ্যের মর্যাদা লাভ করেছে ২০২১ সালের নভেম্বরে।
- রংপুরের শতরঞ্জি: রংপুর অঞ্চলে তৈরি হওয়া এক প্রকার কার্পেটের নাম শতরঞ্জি। তা শতশত বছর ধরে তৈরি করছে রংপুরের তাঁতিরা। হালের চাহিদা অনুযায়ী ফ্লোরম্যাট, ওয়ালম্যাট, মানিব্যাগ, পাপোষ, জায়নামাজ, স্কুলব্যাগ-সহ নানা কিছু তৈরি করে উদ্যোক্তারা। রংপুরের তাঁতিদের দক্ষতার কারণে এটি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। এ কারণে ২০২১ সালের এপ্রিলে মর্যাদা লাভ করেছে দেশের ৬ষ্ঠ জিআই পণ্যের।
- বাংলাদেশের কালিজিরা চাল: এক প্রকার সুগন্ধি জাতের ধানে নাম কালিজিরা। এর উৎপত্তিস্থল ময়মনসিংহ। তবে সমগ্র দেশে উৎপদান হয় এই চাল। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে ২০২১ সালের মে মাসে দেশের ৭ম পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
- দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল: চিকন ও সুগন্ধি এক প্রকার ধানের নামে কাটারিভোগ। এ ধান প্রাচীনকাল থেকে দিনাজপুরে উৎপাদন হয়। দিনাজপুরের মাটি ব্যতীত অন্যস্থানে আবাদ করলে সুগন্ধি কমে যায়। এ কারণে দিনাজপুরের নামে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে কাটারিভোগ চাল।
- বিজয়পুরের সাদা মাটি: এক প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ। এই মাটি সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। ২০২১ সালের জুন মাসে দেশের ৯ম জিআই পণ্যের সনদ লাভ করে।
- বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহে লোনা পানিতে চাষ করা হয় বাদগা চিংড়ি। সম্পূর্ণভাবে বাণিজিক্য ও রপ্তানির উদ্দেশ্যে করা হয় এই চিংড়ির উৎপাদন। বিশ্বের শীর্ষ দশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ২০২২ সালের এপ্রিলে দেশের দশম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি। যা আমাদের রপ্তানির বাজার আরও সমৃদ্ধ করেছে।
- রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম: ফজলি আম রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের অন্য স্থানে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপদান হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ফজলি আমের শাঁসে কোন আঁশ নেই এবং খেতে মিষ্টি। দেশের অন্য স্থানে উৎপাদন হলেও এই দুই জেলার ফজলি আমের সাইজ ও স্বাদ আলাদা। এটি ২০২২ সালের ২৪শে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়।
শরিয়তপুরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কারণে শরীয়তপুরে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা। এ কারণে জেলা ব্র্যান্ডিং ট্যাগলাইন করা হয়েছে ’সোনালী সেতুর শ্যামল ভূমি শরীয়তপুর।’ এ জেলায় বেড়েছে পর্যটন ও স্থানীয় পণ্যের সম্ভাবনা। পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার কারণে মিষ্টিসহ বিভিন্ন ধরণের স্থানীয় পণ্য সহজে আনা যাবে রাজধানী ঢাকায়। এর ফলে বাড়বে এসব পণ্যের পরিচিতি, চাহিদা, কর্মসংস্থান এবং শরীয়তপুরের অর্থনীতি। অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো অন্তত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এ জেলায় উৎপাদন হয়ে আসছে, কিছু মানুষের জীবীকা এসব পণ্য নির্ভর। শরীয়তপুরের ব্র্যান্ডিং ও অর্থনীতির স্বার্থে এসব পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দরকার। সম্ভাব্য কয়েকটি জিআই পণ্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে তোলে ধরেছি-
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্ত্তিকপুরের মৃৎ শিল্পের ইতিহাস ২০০ বছরের বেশি। এটি পাল বংশের আদি পেশা। এখনো তারা যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন রকম খেলনা, শো-পিচ, তৈজষপত্র, মটকাম হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি। দেশের পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক দেশেই যায় কার্ত্তিকপুরের মৃৎ শিল্পিদের উৎপাদিত পণ্য।
শরীয়তপুরের কাসা শিল্প একটি প্রাচীনশিল্প। কংশবণিক বংশধরঘন কাসা-পিতল দিয়ে প্রয়োজনীয় নানারকম দ্রব্যসামগ্রী নির্মাণ শুরু করে। এখনো কয়েকটি হিন্দু পরিবার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তারা তৈরি করছে কাসার কলস, বালতি, ল্যাম্প, পানদানী ইত্যাদি। এসব পণ্য শরীয়তপুরের চাহিদা মিটিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
শতাধিক বছরের ঐতিহ্য নিয়ে এখনো শরীয়তপুরে তৈরি হয় নড়িয়ার সুস্বাদু সন্দেশ। কথিত আছে, ”প্রায় শত বছর পূর্বে শরীয়তপুরের নড়িয়া বন্দর দিয়ে নদীপথে কীর্তিনাশা নদী দিয়ে ভারতীয় ব্যভসায়ীরা যাতায়াত করতো, তাদের মাধ্যমে মাধ্যমে কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে নড়িয়ার সন্দেশের সুনাম।
পদ্মা সেতুর কারণে পর্যটন বাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। শরীয়তপুরে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি বাড়লে পর্যটকরাও যাওয়ার সময় কিনে নিয়ে যাবে। এভাবে বাড়বে জেলার ব্র্যান্ডিং ও অর্থনীতি। সেই সাথে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে জিআই পণ্যগুলো ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে।
লেখক: স্বত্বাধিকারী, আলিয়া’স কালেকশন।