সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলায় পাট চাষ হয়ে আসছে। ৩ হাজার বছর পূর্বে বাংলাদেশের গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পাট চাষ শুরু হয়েছিল। তবে বাংলায় নতুন করে পাটের উত্থান হয়েছিল ১৮৫০ সালে। অর্থাৎ এরপর থেকে সুপরিচিত হয় বাংলার পাট সোনালি আঁশ রূপে। এরপর থেকে বিশ্বে বাংলার পাট বেশ সুনাম কুরিয়েছে। তবে এই পাটের উত্থান পতনও ঘটেছে বার কয়েক। স্বাধীনতার পরও পাটের সোনালী দিন ছিল।
তবে বৈশ্বিক প্রভাবেও পাট শিল্পের উত্থান পতন হয়েছে। ১৯৩৩ – ৩৪ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার সময় পাটজাত সামগ্রীর চাহিদা বিশ্বজুড়ে হ্রাস পেয়েছিল। তখন পাট-শিল্প মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিল।
১৮৫৩-১৮৫৬ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, প্রথম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং এর পরবর্তী সময়ে বাংলার পাটের চাহিদা তৈরি হয়। শুরুতে কৃত্রিম চাহিদা হলেও পরে তা স্থায়ী চাহিদায় রূপ নেয়।
১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরও ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের উপরে পাটের জন্য নির্ভরশীল ছিল। কেননা পাট উৎপাদন বেশি হতো পাকিস্তানে এবং পাটকল অধিকাংশ ছিল ভারতে।
১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জে বাওয়া পাটকল স্থাপন এবং ঐ একই সালে পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল প্রতিষ্ঠা ভারত পাকিস্তানের এই সমস্যার সমাধান দেয়।
এরপর ষাট ও সত্তর দশকে পাটের সোনালি দিনই বিরাজ করছিল। ষাটের দশকে রাষ্ট্রের সমর্থন ও ভর্তুকিতে পাট-শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এবং পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎসই ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি।
সত্তর দশকের শুরুর দিকে পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় করণের অধীনে পাটকল রাষ্ট্রীয় করণ করা হয়। বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা করা হয়, কিন্তু তা সত্বেও পাট শিল্পের প্রতি সঠিক পরিকল্পনা ও মনোযোগের অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা সহ বেশ কিছু কারণে সত্তর দশকের শেষের দিকে পাট শিল্পে নতুন মাত্রায় লোকসান শুরু হয়।
নব্য স্বাধীন ভঙ্গুর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাব পরেছিল পাট শিল্পেও। ৮০ ও ৯০ এর দশকে পাট শিল্প একদমই খারাপ অবস্থার দিকে যেতে থাকে।
আশির দশকের সময়টাতে পাটকলের শ্রমিকদের সরকারি দলের জমায়েতে যেতে বাধ্য করা হতো, শ্রমিক নেতার নামে সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বাড়তে থাকে পাট-শিল্পে। সময়মতো পাট বিক্রির নিয়ম পরিবর্তন, বিশ্বব্যাংকগোষ্ঠীর কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি এই সবকিছুর দরুণ পাট শিল্পে লোকসান বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৯০ দশকের শুরু তে পাটখাতের উন্নতির লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংক থেকে ১৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেয় বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বব্যাংক এই ঋণ প্রদান করে শর্তসাপেক্ষে। আর শর্তছিল পাটকল বন্ধ করা। সেই সাথে তাঁতের সংখ্যাও কমতে থাকে, শ্রমিক ছাটাই করা হয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাট তো ছিলোই। ফলস্বরূপ নব্বই দশকের শেষের দিকে লোকসান আরও বৃদ্ধি পায়।
১৯৯১ সালে ব্যাংকের নিকট পাটকলগুলোর ঋণের দায় গিয়ে দাঁড়ায় ২০৭৫.৩২ কোটি টাকা যার মধ্যে বিজেএমসির পাটকলগুলোর ঋণের পরিমাণ ১২৯৯.০৫ কোটি টাকা এবং ৩৫ টি বিরাষ্ট্রীয়করণ মিলের টাকার পরিমাণ হয় ৭৭৪.২৭ কোটি টাকা।
ঐ সময় একটা সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয় যে , পাটকল গুলোর অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ছাটাই করতে হবে এবং বিজেএমসির অধীনস্থ মিলগুলি কে রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন করতে হবে। এই পদক্ষেপ সহ অন্যান্য আরও সকল সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক নগদ ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকর ৪ টি মিল বন্ধ ঘোষণা করে। একই সাথে রপ্তানি ক্ষতিপূরণের জন্য তহবিল প্রদান করে এবং অতিরিক্ত শ্রমিক ছাটাইয়ের জন্য বিজেএমসি – এর মিল গুলো কে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে।
এতদসত্বেও অবস্থার কিন্তু কোন উন্নতি হয় নি বরং খারাপ ই হয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংকের সকল সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন করা হয় কিন্তু এরপরও ১৯৯২-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি এবং বিজিএমইএ এর মিল গুলো বিকশিত হয় নি। এমনকি টিকেও থাকতে পারে নি বরং আরও লোকসানের সম্মুখীন হয়েছিল।
১৯৯৮ সালে পাট খাতের ৪১ টি পাটকলের মধ্যে ৩ টি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং লে অফ করা হয় ২ টি কে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব মিলের পুঞ্জীভূত লসের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
১৯৯১-২০০০ সাল পর্যন্ত বিজিএমসি এর অধীনে থাকা মিল গুলোর ঋণের পরিমাণ হয় ৬৯৫.৫৫ কোটি টাকা।
২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে এ অবস্থা আরও খারাপ হয়। ফলস্বরূপ, ২০০২ সালে পাট খাতের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। এতে বিশ্ব ব্যাংক, মার্কিন দূতাবাস, বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো অভিনন্দন জানায়। ২০০২ সালে নতুন পাট নীতি ঘোষণা করা হয়। সময়মতো পাট ক্রয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া বন্ধ থাকে। যার দরুন পাটদ্রব্যের রপ্তানি আনুপাতিক হারে হ্রাস পেতে থাকে। যা আরও বেশি খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যায় বাংলাদেশের পাট-শিল্পকে।
অন্য দিকে, ২০০৫ সালে ভারতে পাট নীতি প্রণয়ন করা হয়। পাট-শিল্পের নতুন বিকাশ ও পরিকল্পনা করা হয়। আর সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নও করা হয়। এতে ভারতকে সাহায্য করে বিশ্বব্যাংক। ২০০১-০২ থেকে ২০০৬-২০০৭ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি এর অধীনে পরিচালিত পাটকল গুলো ১৯১১ কোটি টাকা লোকসানের মুখ দেখে। বেসরকারি খাতের পাটকল গুলোর অবস্থাও ভালো ছিল না।
বাংলাদেশেে দিনমজুর ভিত্তিক বেসরকারি পাটকল স্থাপন করা হলেও ২০০৭ সালে আবার শ্রমিক ছাটাই এবং পাটকল বন্ধের নতুন কর্মসূচি শুরু হয়। এমনকি ২০০৭ সালের পরবর্তী সময়েও পাট-শিল্পে বৈরী নীতি অব্যাহত থাকে।
এতো খারাপ অবস্থার মধ্যেও যেন পাটের সোনালী ঝলমলে দিন উঁকি দিয়েছিল। পাটের জন্মলগ্ন থেকেই আমরা পাটের দড়ি বস্তার বাইরে এর ব্যবহার সম্পর্কে তেমন জানি না। পাটকলগুলোর লোকসান যখন চারিদিকে তখন অন্যদিকে একদম নতুন উদ্যোক্তা পাট থেকে সুতা তৈরির কারখানা স্থাপনায় ব্যস্ত। তারা পাট সুতার কারখানা স্থাপন করলেন। ইউরোপের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি করা হয় পাট৷ ফলস্বরূপ ২০০৭ সালেই চিংড়ি কে টপকে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ২য় অবস্থানে চলে আসে।
ফলশ্রুতিতে বেসরকারি বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী পাট খাতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসে। এসময় বাংলাদেশে পাট সুতার নতুন নতুন কারখানা স্থাপিত হতে থাকে।
কিন্তু পাট-শিল্পের দুর্ভাগ্য যেন তার ললাট থেকে সরতেই চাইছে না। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, ফলস্বরূপ বিশ্ব মন্দা। কৃত্রিম আঁশের দাপট তখন বাড়তে থাকে। এতে করে পাট রপ্তানি কমে যায়। আবার পাট শিল্প যেন মুখ থুবড়ে পরে যায়। বিশ্ববাজারে পাটের দাম হ্রাস পাওয়ার প্রভাব পরে বাংলাদেশেও। বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পরেন,নিজেদের এই লস মানতে পারেন না৷ কৃষক পাটের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে দুঃখে, ক্ষোভে পাট ক্ষেতে আগুন দেয়। পাটের চাষ কমতে থাকে ধীরে ধীরে। পাট খাতের সাথে জড়িত সকলের মধ্যে বিরাজ করে রাজ্যের হতাশা।
পাট সোনালী আঁশ। পাটের সেই সোনালি সুদিন ফিরে না আসলেও, পাট-শিল্পের বিকাশ তেমন না হলেও, পাট খাতের সকলের মধ্যে হতাশা বিরাজ করলেও পাটের সোনালী ঝলকানি যেন “শেষ হইয়াও হয় না শেষ”।
কেননা পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। পাট থেকে তৈরি সকল পণ্যই পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশের জন্য ভালো যা তা সবকিছুর জন্য ই ভালো। পৃথিবীর মানুষ দেরীতে হলেও তা বুঝতে পারে। কৃত্রিম আঁশের খারাপ দিকগুলো সামনে আসতে খুব বেশি সময় লাগে নি।
পাটখাতের সকল মানুষ হতাশ, পাট চাষে আগ্রহ হারায় চাষীরা। এ অবস্থা আরও ৪/৫ বছর চলতে থাকে। ২০১২ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে আবার পাটের সোনালী সুবাসাত বইতে শুরু করে। উন্নত বিশ্বে কৃত্রিম আঁশের ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় এনে এর বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে উঠতে থাকে।
মূলত একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ই আবার পাট শিল্পের উত্থানের দিন শুরু হতে থাকে । ধীরে ধীরে পাটের সোনালি সুদিন ফিরে আসতে শুরু করে। বর্তমানে পাট শিল্প নতুন ভাবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে বিশ্বজুড়ে। নতুন ও তরুণ উদ্যোক্তাদের ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বিশ্বজুড়ে পাট শিল্পের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে।
Ruma Akhter
Owner & Designer of Jute Heaven.