রিমি খোন্দকার, ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায় জন্ম। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা ফেনীতে,ফেনী জিয়া মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় গমন।এরপর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন। স্বাধীনভাবে নিজে কিছু করতে চাওয়া থেকে হয়ে উঠেন উদ্যোক্তা ।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরু সর্ম্পকে জানতে চাই ?
অনেক দিন থেকেই পড়াশুনা করছিলাম ইকমার্স নিয়ে। তারপর সিদ্ধান্ত নিই দেশীয় বিভিন্ন শাড়ি নিয়ে কাজ করব কারন আমি নিজে শাড়ি পরতে ভালবাসি। এরই মধ্যে শুরু হলো করোনা আর লকডাউন, পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। অন্যদিকে নিজের,নিজের ফ্যামিলির আশেপাশের সবার অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়। কাউকে হেল্প করতেও পারছিলাম না।
যেহেতু অনেক দিন ধরে ই-কমার্স নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম, তাই কিছু এলাকার তাঁতীর সাথে আগেই যোগাযোগ হয়েছিল। হাতে ছিল ২০হাজার টাকা পুঁজি। ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই ২০ হাজার টাকার পুরোটা দিয়েই শাড়ি কিনে ফেলি।
করোনায় বসে অর্থনৈতিক ভাবে,মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা,মানসিক প্রশান্তির জন্য একটা উদ্যোগ নেয়া খুব জরুরী ছিল। আমি শুধু নিজে ব্যবসা করতে চাইনি,চেয়েছি ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে আমার আশেপাশের সবার উপকার করতে।এখানে মানবিকতার ব্যাপারও জড়িত ছিল।
১লা মে অফিসিয়ালি আমার পেইজ গোলাপজানের যাত্রা শুরু করি। শুরুতে ভেবেছিলাম গোলাপজানে শুধু শাড়ি রাখব। এরই মধ্যে খবর পেলাম পাবনার এক তাঁতীর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ লকডাউনের কারনে, তার ঘরে খাবার নেই, কিন্তু লুঙ্গী আছে।আমি ভাবলাম তার থেকে কিছু লুঙ্গী কিনে নিই তাহলে তার উপকার হবে। আশ্চর্যের বিষয় লুঙ্গীগুলো আনার একদিনের মাথায় সব সেল হয়ে গেছে। এরপর থেকে ঐ তাঁতী থেকে আমি নিয়মিত লুঙ্গী নিচ্ছি এখনো।
গোলাপজান নামটা কেন?
অনেকেই জিজ্ঞেস করে এই নামটা কেন দিলাম! আসলে আমার মাথায় শুধু পেইজ খুলব আর সেল করব এমন ব্যাপার ছিলনা। আমি চেয়েছি পুরোনো ধাঁচের একটা ইউনিক নাম,অবশ্যই বাংলা হতে হবে।আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের দাদি নানিদের নামগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তাই গোলাপজান নামটা বেছে নিয়েছি, আমাদের দাদি নানিদের নামকে স্মরণ করার জন্য।আর দাদি নানিরা সবসময় শাড়ি পরত,পেইজে যেহেতু শাড়ি সেল হবে এটাও একটা কারন।
আমাদের স্লোগান – Golapjaan – পোশাকে ফুটে উঠুক আপনার ব্যক্তিত্ব।
গোলাপজান নিয়ে আপনার স্বপ্ন
স্বপ্ন আকাশছোঁয়া, আমি চাই গোলাপজান দেশের সবার কাছে পরিচিত হোক,সবাই গোলাপজানকে চিনুক।গোলাপজান বিপন্ন মানুষের সহায়তায় সবসময় পাশে দাঁড়াবে,অসহায়কে সাহায্য করবে। বিজনেসের থেকে মানবিকতা বড় হোক।
ফেনীতে পরিচিতি
খুবই খুশির খবর ফেনীর উদ্যোক্তাদের মাঝে,ফেনীর ফেসবুক কমিউনিটির মাঝে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পেরেছি। সত্যি কথা বলতে ঢাকাতে বসে কাজ করলেও আমার সবচাইতে বেশি সেল হয় কিন্তু ফেনীতে।ফেনীর আপুদের ভালবাসায় আমি মুগ্ধ।
আমি নিজেকে ফেনীর মেয়ে,ফেনীর উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি।আমি চাই নিজের মাধ্যমে, গোলাপজানের মাধ্যমে প্রাণের জেলা ফেনীকেও ধরতে। চাই সবাই আমার নামের আগে বলুক ফেনীর রিমি আপু ।
ক্যারিয়ারে ই-কমার্স বিজনেসকেই কেন বেচে নিলেন?
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশুনা শেষ করে গতানুগতিক ধারার চাকরিতে না গিয়ে কেন উদ্যোক্তা হলাম? অনেকেই এই প্রশ্ন করেন। আসলে আমি চেয়েছি স্বাধীনভাবে নিজে কিছু করতে সবসময়। ধরাবাঁধা, যেটাতে নিজে কিছু করার সুযোগ নেই এমন কিছু করতে চাইনি। এজন্যই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।
অনুপ্রেরণা
উইয়ের রাজীব ভাইয়া এবং নিশা আপু আমার অনুপ্রেরণা। উনাদের দেখে উদ্যোক্তা হতে অনেক সাহস পেয়েছি। নয়তো এতদূর আসতে পারতাম না।
পুঁজি
২০হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করে ২মাসে আমার সেল প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা,পরে আরো কিছু টাকা এড করেছি পুঁজির জন্য ।এরমধ্যে ১লক্ষ ১০হাজার টাকা সেল হয়েছে উই গ্রুপে।আমি একটা প্রোডাক্ট বিক্রি করে সেই টাকা আবার পুনরায় বিনিয়োগ করেছি। এভাবে বিনিয়োগ বাড়িয়েছি।
খরচ
বিজনেসের কিছু প্রোডাক্ট আমি ঈদে আত্মীয়দের গিফট করেছি। আশেপাশে কিছু মানুষকে অল্প পরিমানে সাহায্য করেছি সামর্থ্য অনুযায়ী।
পারিবারিক সাপোর্ট
বিজনেস শুরু করার পর সবার সাহায্য পেয়েছি,সবাই সাপোর্ট করেছে। আমার বর মাইনুল আমাকে অনেক বেশি সাপোর্ট করেছে,এজন্য তার নিকট অনেক কৃতজ্ঞতা। আমার ভাইবোনেরা পুঁজি দিয়ে, শুশুর বাড়ির থেকেও সাপোর্ট পেয়েছি প্রোডাক্ট কিনে আমাকে উৎসাহ দিয়েছে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
ব্যবসার প্রধান উদ্দেশ্য বিক্রি এবং সেল হলেও আমি এই ধারার বাইরে যেতে চাই। আমি চাই এটা এক ধরনের সেবাও হোক। প্রায়ই কেউ বলে মায়ের জন্য শাড়ি নেবে,বাবার জন্য লুঙ্গী নেবে কিন্তু তার বাজেটে হচ্ছে না। তখন আমি ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনেক কমে ( সামর্থ্য থাকলে ফ্রি দিতাম) পণ্য বিক্রি করি।
আমাদের দেশের ফ্যাশন জগতটা ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার মানুষেরা নিত্য নতুন পোশাক সবার আগে পায়।আমি চেয়েছি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছেও যেন আপডেট পণ্য পৌঁছাতে পারি। তাছাড়া আমার আরেকটা উদ্দেশ্য বাজেট ফ্রেন্ডলি পোশাক রাখা। যাতে করে সবার হাতের নাগালের মধ্যে থাকে আমার পণ্য।
ভবিষ্যৎ ভাবনা
আমার মাথায় বর্তমানে গোলাপজান ছাড়া কিছু নেই। আমার ধ্যান জ্ঞান সবকিছু গোলাপজানকে নিয়ে। গোলাপজান ধীরে ধীরে অনেক বড় হবে,গোলাপজানকে এগিয়ে নিয়ে যাব ।
দুঃসময়
উদ্যোগ শুরু করার দুই মাসের মাথায় জুনের ২২ তারিখ করোনা আক্রান্ত হলাম। নতুন উদ্যোগ তাই কাজের ধারাবাহিকতা থাকাও জরুরী। করোনা নিয়েও কাজ করেছি,পেইজে অর্ডার নিয়েছি, গ্রাহকদের থেকে সময় নিয়েছি প্রোডাক্ট ডেলিভারি দেয়ার জন্য ।
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) অর্থাৎ উইতে লাখপতি হওয়ার গল্প
উইতে লাখ পতি অর্থাৎ লাখ টাকার সেল হয় ৮ জুলাই। এজন্য আমি রাজিব ভাইয়া ও নিশা আপুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এমন একটা দেশীয় পণ্যের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার জন্য। আমি কাজ করেছি সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্য শাড়ি,লুঙ্গী ও থ্রিপিস নিয়ে। রোজা থেকেই টুকটাক বিক্রি শুরু হয়। আস্তে আস্তে সেই অল্প অল্প বিক্রি লাখে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে জুলাইয়ের ৮ তারিখ অব্দি।