হেবাং নারী পরিচালিত প্রথম পাহাড়ি খাবারের রেস্তোরাঁ। চার বোন এর পরিচালনায় আছেন। রেস্তোরাঁ চালুর আগে ২০১৬ সাল থেকে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে পাহাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করত হেবাং। হেবাং পাহাড়ী খাবারের একটি ইউনিক রেস্টুরেন্ট যা ঢাকায় মিরপুর কাজীপাড়াতে অবস্থিত।
গত ১৬ ডিসেম্বর চালু হয় হেবাং। অনলাইনে পাহাড়ি খাবার সরবরাহের বা আজকের রেস্তোরাঁ—দুটির চিন্তাই আসে চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় প্রিয়াঙ্কা চাকমার মাথা থেকে। তবে খাবারের রেসিপি গুলো তারা নিজেরায় তৈরী করে। দেশের লোকেরা সবাই বিদেশি খাবার ও স্ট্রিট ফুড পছন্দ করে তাহলে কেন আমাদের পাহাড়ি খাবারগুলো কেন পছন্দ করবে না মূলত এই অনুপ্রেরণায় আজকের হেবাং।
হেবাং রেস্তোরাঁ খাবারের মধ্যে আছে হাঁস, বেলে মাছ, কাঁকড়ার নানা পদ। ব্রয়লার মুরগি আছে। তবে পাহাড়ের বনমোরগও পাওয়া যায়। বর্ষার দিনে বাঁশ কোড়ল দিয়ে তৈরি নানা পদ থাকে। কোড়লের মধ্যে মুরগির মাংস ঢুকিয়ে ‘বাচ্চুরিমালা’ তো বিখ্যাত। দুপুর ও রাতের খাবারের বিভিন্ন পদের সঙ্গে আছে নানা পাহাড়ি পিঠা।
“চার বোনের ভারতের শরনার্থী জীবন ও হেবাং এর গল্প জানাচ্ছেন বিপ্লী চাকমা স্বত্তাধিকারী হেবাং রেস্তোরাঁ
বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক এবং মা ফ্যামিলি প্লানিং’ এ চাকুরীজীবি । আমরা চার বোন বিপ্লী, প্রিয়াংকা, সুচিন্তা ও স্বস্তি।১৯৮৬’ই সালে অগ্নিসংযোগের হামলায় আমাদের পরিবারটি ভারতে শরণার্থী হতে হয়। তখন আমার (বিপলীর) বয়স মাত্র দের বৎসর । আর প্রিয়াংকা ছিল মায়ের পেটে( মা তখন সাড়ে ৭ মাসের অন্তসত্তা)।এই অন্তসত্তা পেট নিয়ে জংগলে জংগলে হেটে লুকিয়ে লুকিয়ে ভারতে শরনার্থী শিবিরে পৌঁছায় আমার মা। মাত্র একসপ্তাহের পরেই শরনার্থী শিবিরে প্রিয়াংকার জন্ম হয়। চার বোনের মধ্যে তিন বোনের জন্মই শরনার্থী শিবীরে। শরণার্থী জীবনে আমাদের বাবা ব্যবসা করতেন। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও সে কারনে টাকা পয়সার এতো অভাব ছিল না। শরনার্থী শিবিরের পরিবেশ ভালো না হওয়াতে মা – বাবা আমাদের দুই বোনকে লেখাপড়ার পাশাপাশি দিলেন নাচের ক্লাসে। যাতে আমরা সেই পরিবেশের সাথে মেলামিশা করার সময় না পায় আমি আর প্রিয়ঙ্কা সুন্দর নাচের জন্যে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় রাজ্য সরকার কতৃক বিশেষভাবে পরিষ্কৃতও হয়েছিলাম। আমাদের সবার পড়াশুনার শুরুটাও শরনার্থী শিবীরের স্কুলে । শিবিরের স্কুল শুধুমাত্র ৮ম শ্রেনি পর্যন্ত হওয়ায় আমি আর মা ক্লাস নাইনে ভর্তির জন্য বাংলাদেশে চলে আসি। (তখন ভারতে আমরা প্লেনে বা গাড়িতে নয় ৫ ঘন্টা পায়ে হেটে আসা যাওয়া করতাম।) মা মহালছড়ি, খাগড়াছড়িতে স্কুলে ভর্তি করায়ে আমার বাবার চাচাতো ভাই বড় চাচার বাসায় রেখে চলে যান ভারতে। শুরু হয় আমার নতুন অধ্যায়। শুধু এই টুকু বলবো পরিবারের সব কাজ ছেড়ে রাত ১২ টায় পড়তে বসতে হতো আমার। পরের বাড়িতে মা-বাবা ছাড়া থাকা যে কি যন্ত্রণাদায়ক তা বোঝাতে পারবো না। সে সময় সুবিধা অসুবিধা শেয়ার করার মত ফোন ও ছিল না, তাও অনেক সহ্য করে এক বছর পড়ার পর ভালো রেজাল্ট করে ১০ম শ্রেনীতে উঠলাম। শান্তিচুক্তির পর আমাদের পুরো পরিবার প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশে, মা-বাবা তাদের চাকুরী গুলো ফেরত পায় আর আমার বোনদের পড়াশুনা শুরু হয় আবার বাংলাদেশে। আমাদের বাড়ি দীঘিনালা, খাগড়াছড়িতে। কিন্তু আমার মহালছড়ি স্কুলে রেজিষ্ট্রেশন হওয়ায় সেখান থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে তারপর মা বাবার কাছে ফিরে যেতে হয়।
বর্তমানে আমি ১৩ বছর ধরে আদ্-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজে ‘কলেজ সেক্রেটারি ” হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্বে আছি আর প্রিয়াংকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) বিভাগ এ মাস্টার্স করে পরবর্তীতে আবার স্কোলারশিপ পেয়ে ইতালি পাডুয়া ইউনিভার্সিটি থেকে লোকাল ডেভেলোপম্যান্ট স্টাডিজ-এ মাস্টার সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশে UNFPA তে চাকুরত আছে এবং ছোট দুই বোনের মধ্যে সুচিন্তা মাত্র এম বি এ শেষ করে বিয়ের পিড়িতে বসেছে ও স্বস্তি BSC in Physiotherapy (NITOR) এ ফাইনাল বর্ষে পড়ালেখা করছে।
আমদের “হেবাং” খোলার উদ্দোগ ছিল প্রিয়াংকার সে হিসেবে হেবাং এর মূল উদ্যোক্তা প্রিয়াংকা। তবে খাবারের রেসিপি গুলো আমি নিজেই তৈরী করি। ইতালি থেকে ফিরে সে যখন দেখে বাংলাদেশের লোকেরা সবাই বিদেশি খাবার ও স্ট্রিট ফুড পছন্দ করে তাহলে কেন আমাদের পাহাড়ি খাবারগুলো কেন পছন্দ করবে না? এমনিতেই প্রিয়াংকার ঢাবি-র হলের বন্ধু বান্ধবীরা আমাদের রান্না আর খাবার গুলো খুব পছন্দ করতো। তারা প্রায় বলতো একটা পাহাড়ি খাবারের রেস্টুরেন্ট দিতে। মূলত তাদের অনুপ্রেরণায় আজ আমদের হেবাং।
আমার প্রথম দিকে সাহস ছিল না কারন আমার চাকরি, বাচ্চা আর সংসার এর পাশাপাশি কেমনে সামাল দিবো সেই চিন্তা করে।পরবর্তীতে প্রিয়াংকা আমাকে সাহস যুগিয়েছে, প্রতিদিন বুঝায় আমাকে নানান উদাহরণ দিয়ে। পরে তার কাছে নত হয়ে রাজি হলাম আর সাথে সাথে পেজ খুলে ফেলে। সেদিন ছিল ২০১৬ সালে ৪ ফেব্রুয়ারী। পেজে কি নাম দিবে? ঠিক করলাম সেহেতু পাহাড়িদের বিখ্যাত খাবারের রেসিপি হেবাং তাহলে হেবাং-এ হোকা প্রথম পাহাড়ি খাবারের রেস্টুরেন্ট। সেদিন পোস্ট দেয়ার পর যখন দেখি ১০ টা অর্ডার তখন মনে সাহস পেলাম। প্রিয়াংকার দেখিয়ে দিয়েছে চাকরী এবং পড়াশুনার পাশাপাশিও উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব। পুঁজিবাদ বিশ্বে চাকরী দিয়ে জীবন ঘুরানো কঠিন। এটাও বুঝলাম একটিমাত্র উপার্জনের উপর নির্ভর করে আর্থিক সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। বেশ, হেবাং এর যাত্রা।
করোনার লকডাউনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছে, তখন উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর মাধ্যমে আমাদের বিক্রয় অভ্যহৃত ছিল।