ছোটবেলা থেকে আমরা ঘরে তৈরি যেসব খাবার খেয়ে বড় হয়েছি ই-কমার্সের যুগে তা ‘হোম মেইড ফুডের’ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। হোম মেইড ফুড কেন্দ্র করে বিশাল মার্কেট গড়ে উঠেছে। এখানে ক্রেতা বিক্রেতাদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত। প্রতিনিয়ত মানুষ হোম মেইড ফুডের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। তাই কদর বাড়ছে ঘরে তৈরি খাবারের।
‘হোম মেইড ফুড’ উদ্যোক্তাদের প্রায় শতভাগ উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার কারণে তারা প্রতিনিয়ত ক্রেতার চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা, স্বাস্থ্যবিধিসহ নানা বিষয়ে জানার চেষ্টা করছেন। ক্রেতাদের আবেগ অনুভূতির অংশ হতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। এ জন্য ক্রেতারা আন্তরিকতা ও নিশ্চতার জন্য হোম মেইড ফুডে নির্ভরতা বাড়িয়েছে। আগে দেখা যেতো বিবাহ বার্ষীক, জন্ম বার্ষিকের মতো বিশেষ দিনগুলোতে মানুষর পরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। বর্তমানে রেস্টুরেন্টের পরিবর্তে কেউ কেউ হোম মেইড ফুডে নির্ভর করছে। কয়েক জন হোম মেইড ফুডের ক্রেতার সাথে কথা বলে পরিষ্কার হওয়ার গেছে, বিশেষ দিনগুলোতে তারা বিশেষ পদ খেতে চায়। এই দিন তারা নিজের মতো সাজতে চায়, গল্প করতে চায়, আনন্দ করতে চায়। তাই খাবার তৈরি করতে গিয়ে রান্না ঘরে কাটাতে চায় না নিজের সময়গুলো। আর হোম মেইড ফুডের উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে ক্রেতার চাহিদার প্রতিটি পদ তৈরি করেন। যত্ন করে পৌঁছে দেন ক্রেতার বাসায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিরকুট কিংবা উপহার দিয়ে ক্রেতার বিশেষ দিনে আনন্দিতও করেন। এছাড়াও কাউকে খাবার উপহার পাঠাতে হলে ক্রেতার হয়ে সেই কাজটি যত্নের সাথে করে দেন হোম মেইড ফুডের উদ্যোক্তারা।
নির্দিষ্ট কোন খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সব ধরণের খাবার তৈরি করছেন হোম মেইড উদ্যোক্তারা। ফাস্ট ফুড থেকে শুরু করে পিঠা, পায়েস, নাড়ু, হালুয়া, মিষ্টি, ভাত-তরকারি, কেক-বিস্কুট, কেক, পুডিং সহ চাহিদার সকল খাবার পাওয়া যায় হোম মেডই ফুডে। শুধু প্রয়োজন হয় নিজের চাহিদা মতো একজন উদ্যোক্তা খুঁজে নেওয়া এবং চাহিদার বুঝিয়ে দেওয়া। তবে হোম মেডই ফুড ইন্ডাস্ট্রি এখনো শিশু পর্যায়ে রয়েছে। ঢাকা শহরে তা দ্রুত বাড়লেও জেলা শহরগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম উদ্যোক্তা রয়েছে। উদ্যোক্তা থাকলেও তাদের পরিচিতি কম হওয়ার কারণে চাহিদা পূরণ করতে প্রায় সময় ব্যর্থ হয় ক্রেতারা।
হোম মেইড ফুডের প্রচার বাড়াতে ক্রেতা বিক্রেতার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রথমত হোম মেইড ফুড নিয়ে ইন্টারনেটে নিয়মিত আলোচনা করা দরকার। উদ্যোক্তারা খাবারের নানাদিক তোলে ধরতে পারেন, হোম মেইড ফুডের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক, স্বাস্থ্যবিধি, যত্ন, আন্তরিকতা, চাহিদা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়মিত আলোচনা করতে পারেন। কারণ প্রত্যেক মানুষের আলাদা চাহিদা রয়েছে। তাই যত বেশি আলোচনা হবে সেখান থেকে একজন ক্রেতা তার চাহিদা খুঁজে পাবেন এবং তা পূরণের জন্য তিনি বিক্রেতার দ্বারস্থ হবেন। ক্রেতাদের সাথে প্রতিদিন তৈরি হয়ে যাওয়া গল্পগুলো সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারেন উদ্যোক্তারা। সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করার মাধ্যমে অন্যদের জানাতে পারেন। এতে করে মানুষ জানতে পারবে এবং তাদের চাহিদা পূরণ করতে হোম মেইড ফুডের উৎস খুঁজে পাবেন।
একই সাথে ক্রেতারাও ভূমিকা রাখতে পারেন প্রচারে। প্রথমত তারা যে উদ্যোক্তার থেকে হোম মেইড ফুড কেনাকাটা করেন তার প্রতিটি বিষয় খেয়াল রাখতে পারেন। একজন উদ্যোক্তা তার চাহিদা কিভাবে পূরণ করেছেন? কোন বিষয়গুলো প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পূরণ হয়েছে, উদ্যোক্তার যোগাযোগ, রান্না, প্যাকেজিং সহ নানা বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন। ক্রেতার রুচির সাথে উদ্যোক্তার রান্না কেন মিলে গেছে ইত্যাদি বিষয়গুলো তোলে ধরতে পারেন। এতে করে ক্রেতার পরিচিত অন্যরা জানার সুযোগ পাবে এবং তাদের চাহিদা পূরণের জন্য হোম মেইড ফুডে নিশ্চিন্তে ভরসা করতে পারবে। এ ছাড়াও একজন ক্রেতা তার নিকটস্থ লোকদের কাছে হোম মেইড ফুড সম্পর্কে বলতে পারেন।
ক্রেতাদের মনে যত রকম প্রশ্ন তৈরি হয় তা পোস্ট কমেন্টের মাধ্যমে তোলে ধরতে পারেন। একই প্রশ্ন অসংখ্য ক্রেতার মনে ঘুরপাক খেতে পারে তাই একজনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য পোস্ট বা কনটেন্ট লিখলে অন্যরা জানার সুযোগ পাবে। এতে করে অন্য ক্রেতারা যেমন তাদের চাহিদা পূরণের উত্তর পাবেন তেমনি হোম মেইড ফুড নিয়ে আলোচনা বাড়বে।
হোম মেইড ফুডের উদ্যোক্তারা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট কমেন্ট করা সহ আরও কিছু কাজ করতে পারে। যেমন তাদের উদ্যোগের ওয়েবসাইটগুলোতে একটা করে ব্লগ সংযোজন করতে পারেন। যেখানে ক্রেতাদের থেকে প্রাপ্ত রিভিউ, তাদের প্রশ্নের উত্তর, ক্রেতাদের উদ্দেশ্যের শেয়ার করা দিকনির্দেশনা, সতর্কতা, সচেতনতা সহ নানাকরম তথ্য উপাত্ত প্রকাশ ও প্রচার করতে পারেন। এতে করে যে কেউ ইন্টারনেটে সার্চ করার মাধ্যমে হোম মেইড ফুড নিয়ে তার প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাবেন। উদ্যোক্তারা ক্রেতাদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন এবং তা প্রচার করতে পারবেন। পরিবেশবান্ধব খাদ্য, নিরাপদ খাদ্য, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সহ নানা বিষয় নিয়ে নিজেরা জানার পাশাপাশি তা ব্লগ, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে পারেন। খাবারের উৎপাদন সতর্কতা থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় তোলে ধরতে পারেন যেন স্বস্থ্যকর খাবার নিয়ে ক্রেতাদের সরে কোন প্রশ্ন না থাকে।
এছাড়াও কয়েকজন উদ্যোক্তা মিলে ডকুমেন্টেরি তৈরি করতে পারেন, একটা ওয়েবসাইট বা ব্লগ প্রচার করতে পারেন, গণমাধ্যমে আলোচনা করতে পারেন। সম্মেলিত প্রচেষ্টায় ভিডিও, ছবি, নিউজ লেটার ইত্যাদি তৈরি করতে পারেন। কাস্টমার মিটআপ আয়োজন করার মাধ্যমে ক্রেতাদের চাহিদা, পছন্দ ইত্যাদি নিয়ে জানতে পারেন। ক্রেতাদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাশা জানার সুযোগ হবে। ক্রেতার সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ হবে।
যেকোন উদ্যোক্তার কাস্টমার রিভিউ, নিউজ কিংবা ফিচার প্রকাশ হলে অন্য উদ্যোক্তারা তা প্রচার করার মাধ্যমে হোম মেইড ফুডের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন। একজন উদ্যোক্তা অন্যজন উদ্যোক্তা থেকে কেনাকাটার মাধ্যমে তাদের সেবা, খাদ্যের মান, যোগাযোগ পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এতে করে নিজের জ্ঞান বাড়ার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের সাথে পরিচিতি বাড়বে।
ফেসবুকের মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে করে একসাথে বহু রকমের হোম মেইড ফুড উদ্যোক্তার পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রেতা শ্রেণি গড়ে উঠবে। অর্থাৎ পোলাও পায়েসের জন্য একজন উদ্যোক্তাকে অর্ডার করলে এই গ্রুপে কেকের উদ্যোক্তার কাছেও অর্ডার করা যাবে কিংবা ভর্তা ভাত অর্ডার করা যাবে।
সর্বপরি বলতে হয় হোম মেইড ফুডের প্রচার বাড়াতে কিছু উদ্যোক্তাকে এগিয়ে আসতে হবে। একজন উদ্যোক্তা অন্যজন উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করতে হবে, পরিচিতি বাড়াতে ভূমিকা রাখতে হবে কিংবা রেফারেন্স দেওয়ার মানুষিকতা থাকতে হবে। একজন আরেকজন নিয়ে পোস্ট কমেন্ট করার মাধ্যমে নিজেদের পরিচিতি শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে। এতে করে দ্রুত বড় হবে ক্রেতা শ্রেণি ও হোম মেইড ফুডের ইন্ডাস্ট্রি। যা সকলের জন্য সুফল নিয়ে অসাবে।
লেখক: মোঃ দেলোয়ার হোসেন। স্বত্বাধিকারি: আওয়ার শেরপুর।